কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নির্দলীয় দাবি করা হলেও এর নেতৃত্বে রয়েছেন একাধিক ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতারা। সমন্বয়কদের নামের তালিকায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে পাঁচজনই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামের একটি ছাত্রসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এই সংগঠনটির নেতারাই আন্দোলনের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
নির্দলীয় নয়, শীর্ষ নেতৃত্বে ছাত্রশক্তির নেতারাগত ৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি ঘোষণা করা হয়।
৬৫ সদস্যের ওই কমিটিতে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহসমন্বয়ক রয়েছেন। এই কমিটির তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, সমন্বয়কদের প্রথম ১০ জনের মধ্যে পাঁচজনই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। তাঁরা হলেন ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব নাহিদ ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়ক আসিফ মাহমুদ ও যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল কাদের এবং সদস্যসচিব মো. আবু বাকের মজুমদার ও যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল হান্নান মাসুদ। সমন্বয়কদের তালিকায় ১১ নম্বরে থাকা সোহাগ মিয়াও ছাত্রশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
একাধিক সূত্র জানায়, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন সংগঠন গণ অধিকার পরিষদ থেকে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বেরিয়ে গিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি গঠন করেন। গত বছরের ৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। সংগঠনটির আহ্বায়ক হন ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। তিনি ২০২১ সালের ১৭ মার্চ থেকে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন।
আখতার হোসেন ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে দল থেকে পদত্যাগ করেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যাত্রা শুরুর দিন ৩১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ৩৩ সদস্যের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে আখতার হোসেন আহ্বায়ক ও নাহিদ ইসলাম সদস্যসচিব নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে আসিফ মাহমুদ আহ্বায়ক ও নাহিদ ইসলাম সদস্যসচিব নির্বাচিত হন। কমিটি দুটি এক বছরের জন্য গঠন করা হয়।
কমিটি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ছাত্রশক্তির সদস্যসচিব নাহিদ ইসলাম। তিনি বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তালিকায় ১ নম্বরে আছেন। ছাত্রশক্তির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্যে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চিন্তা ও রাজনীতির সমন্বয় ছাড়া একটি জনগোষ্ঠী নিজেকে বিকশিত করতে পারে না। তাই বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতি পর্যালোচনা ও নতুন একটি ছাত্ররাজনীতি বিকাশের লক্ষ্যে আমরা কিছু শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে নিজেদের ভেতর আড্ডা, আলাপ ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরি করতে সচেষ্ট হই। পাশাপাশি ক্রিয়াশীল বিভিন্ন সংগঠনের সক্রিয় সদস্যরা তাদের সংগঠনের প্রতি আস্থা হারিয়ে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের পরিকল্পনা নিচ্ছি।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক বিকাশের জন্য আমরা একটি নতুন প্ল্যাটফরমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। সেই লক্ষ্যে আমরা কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি নতুন ছাত্রসংগঠন গঠন করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।’
ছাত্রশক্তির কমিটি ঘোষণার পর ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন আখতার হোসেনসহ কয়েকজন নেতা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল, আখতার ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
হামলার ঘটনায় গত বছরের ৪ অক্টোবর ছাত্রশক্তির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘উদ্বোধন কর্মসূচি ও পদযাত্রা থেকে ফেরার পথে পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আখতার হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক লুত্ফর রহমান, যুগ্ম সদস্যসচিব নুসরাত তাবাসসুম, যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুল্লাহ আল গালিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল হাসান, নুসাইবা তাসনিম, যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল হান্নান মাসুদ, সদস্য নিশিতা জামান নিহা, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, সুমনা শারমিন ও সাদিয়া ইয়াসমিনের ওপর ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কিছু নেতাকর্মী একযোগে হামলা চালান।’
সেদিন হামলার শিকার ছাত্রশক্তির যুগ্ম সদস্যসচিব নুসরাত তাবাসসুম এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। তিনি মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গতকাল রবিবার ভোর ৫টায় মিরপুরের একটি বাসা থেকে নুসরাত তাবাসসুমকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ছাত্রশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সদস্য নিশিতা জামান নিহা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুল্লাহ আল গালিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তিনি গত শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নাম ‘শহীদ রুদ্র তোরণ’ ঘোষণা করে একটি কাগজ ঝুলিয়ে দিয়ে আসেন।
একাধিক সূত্র মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন, রিফাত রশীদ, হাসিব আল ইসলাম গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সদস্য। আরেক সহসমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যুগ্ম সদস্যসচিব। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুয়েত মৈত্রী হলে আন্দোলন সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিতে আছেন আরো একাধিক ছাত্রসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের সদস্যসচিব উমামা ফাতেমা দায়িত্ব পালন করছেন সুফিয়া কামাল হলের সমন্বয়ক হিসেবে। ছাত্র ফেডারেশন জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন। জোনায়েদ সাকি বর্তমানে বিএনপি জোটের সঙ্গে মিলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বেশির ভাগই গ্রেপ্তার, পুলিশের হেফাজত বা আত্মগোপনে আছে বলে জানা গেছে।