বিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরজুড়েই অর্থসংকটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ছিল মন্থরগতি। নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবায়নে কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। কিন্তু শেষ মাসে এসে উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে এডিপি বাস্তবায়নের হার। কিন্তু তাতেও সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের রেকর্ড এড়ানো সম্ভব হয়নি, বরং প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও পর্যাপ্ত অর্থছাড় না হওয়ার কারণে সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার নেমেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৮০.৯২ শতাংশ। এমনকি করোনার সময় ছাড়া এর আগে কখনো এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে একই চিত্র দেখা গেলেও বাস্তবায়নের দিকে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় না আনলে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নে উন্নতি সম্ভব নয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইএমইডি। প্রতিবেদন অনুযায়ী বরাদ্দের হিসাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ছাড়া বেশির ভাগই তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। তবে সর্বনিম্ন এডিপির মধ্যে চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের চেয়ে বেশি হারে বাস্তবায়ন করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবছরই শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে বাস্তবায়নের হার বাড়ানো হয়। এতে কাজের মান ঠিক থাকে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জবাবদিহির আওতায় না আনলে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন কোনো অর্থবছরেই সম্ভব নয়।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরী বলেন, প্রতিবছর বড় আকারের এডিপি নেওয়া হয়, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপি বাস্তবায়ন না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির পাশাপাশি অর্থের অপচয় হয় এবং সুফল পাওয়া যায় না।
এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। এ জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘গত অর্থবছরের তুলনায় এবার এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে, এটা ঠিক। আমরা আশা করেছিলাম গত অর্থবছরের তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা গেল সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। তিনি বলেন, মূলত অর্থছাড় কম হওয়ার কারণে বাস্তবায়ন হার কম হয়েছে, বিশেষ করে গত অর্থবছরজুড়ে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড় কমানো হয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এক হাজার ৬৪৭ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ৮০.৯২ শতাংশ।
গত ২০ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার সময় ছাড়া চলতি অর্থবছরের মতো এত কম এডিপি বাস্তবায়ন আর কখনো হয়নি। ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হার ছিল ৮০.৩৯ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ০.৫৩ শতাংশ বেশি।
কিন্তু করোনার আরেক অর্থবছরের (২০২০-২১) বাস্তবায়ন হার ছিল ৮২.১১ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের চেয়েও ১.১৯ শতাংশ বেশি। করোনা ছাড়া অর্থবছর শেষে আগের বছরগুলোর বেশির ভাগ সময় এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৯০ শতাংশের ওপর। এমনকি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে গত অর্থবছরেও বাস্তবায়ন হার ছিল ৮৫.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ করোনার এক বছর বাদ দিলে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নে রেকর্ড করেছে গত অর্থবছর। গত ২০ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। এই দুই অর্থবছরের বাস্তবায়ন হার ছিল যথাক্রমে ৯৪.১১ ও ৯৪.৬৬ শতাংশ।
এদিকে সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন হারের সঙ্গে মাসের হিসাবেও চলতি অর্থবছরে খরচ বেশি হলেও বাস্তবায়ন হার কম হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুধু জুন মাসে এডিপি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ৫৯ হাজার ৪৮২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ সময় বাস্তবায়নের হার ২৩.৩৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয় ৫৫ হাজার ৯৫৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ২৩.৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের হিসাবে বাস্তবায়ন হার কম হয়েছে।
আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাস্তবায়ন হারে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। বিভাগ দুটি পুরো অর্থবছরজুড়ে ৪০ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর মধ্যে সবেচেয়ে কম বাস্তবায়ন করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, সংস্থাটি বাস্তবায়ন করেছে বরাদ্দের মাত্র ৩৪.৭৯ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন বাস্তবায়ন করেছে ৪৬.০৮ শতাংশ।