অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। এসব নিয়ে নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।
বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজি এলপি (লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম) গ্যাসের দাম ১ হাজার ৪১৯ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপিজিএলের একই গ্যাসের দাম মাত্র ৬৯০ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান তরলীকৃত এই পেট্রোলিয়াম গ্যাস বিক্রি করে এত টাকা কম পেলেও এর সিকিভাগ সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। বছরে প্রায় শত কোটি টাকা গচ্ছাই যাচ্ছে এলপি গ্যাস লিমিটেডের।
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালন মুনাফা করেছে মাত্র ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, বণ্টন পলিসিতে মার খাওয়ার জন্যই সরকারি প্রতিষ্ঠানটির এ অবস্থা।
আমরা উপজাত হিসেবে ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে এলপি গ্যাস পাই। এসব গ্যাস বোতলজাত করে বিপিসির চার বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও এসএওসিএলের নিয়োগ করা ঠিকাদারদের সরবরাহ করি। সব সিদ্ধান্তই বিপিসির নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হয়।- এলপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান
জানা যায়, ১৯৭৭-৭৮ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ক্রুড অয়েল প্রক্রিয়াজাত করার সময় উপজাত হিসেবে উৎপাদিত এলপিজি সংগ্রহ করে বোতলজাত শেষে বাজারজাত করতে চট্টগ্রামে এলপিজি স্টোরেজ ও বটলিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করে বিপিসি। প্রথমে যমুনা অয়েল লিমিটেড প্ল্যান্টটি বসালেও বর্তমানে বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এলপিজি বোতলজাত করছে এলপি গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল)।
প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম ও কৈলাসটিলা প্ল্যান্টে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫ হাজার ২১৫ মেট্রিক টন এলপিজি বিক্রি করে। এর মধ্যে সাড়ে ১২ কেজি ওজনের ৯ লাখ ২১ হাজার ৮৪০ বোতল এলপি গ্যাস বিপণন কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করেছে। পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬শ বোতল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ২ লাখ ৪৫ হাজার ১২০ বোতল, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ২ লাখ ৪৪ হাজার ৯৬০ বোতল এবং স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) ১ লাখ ৮৬ হাজার ১৬০ বোতল এলপি গ্যাস বাজারজাত করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও প্রায় সমপরিমাণ গ্যাস বোতলজাত করে এলপিজিএল।
একইভাবে আগের চার বছরে (২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর) পদ্মা অয়েল মোট ১১ লাখ ৯৭ হাজার ৯২০ বোতল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ১২ লাখ ৫০ হাজার ৪৮০ বোতল, যমুনা অয়েল ১১ লাখ ৫০ হাজার ৮শ বোতল এবং এসএওসিএল ৭ লাখ ৯০ হাজার ৬৪০ বোতল এলপি গ্যাস বাজারজাত করে।
এলপিজিএল সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এলপিজি সংগ্রহ করে বোতলজাত করার পর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চার বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ দেওয়া হয়। এলপিজিএল সাড়ে ১২ কেজির প্রতি বোতল গ্যাসের ভোক্তামূল্য (ভ্যাটসহ) ৬৯০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। প্রতি বোতল সাকুল্যে ৫৬০ টাকা দরে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করে এলপিজিএল। কিন্তু বিপণনকারী চার প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও এলএওসিএল ৬৫৫ টাকায় ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে এসব গ্যাস। এতে বোতলপ্রতি ৯৫ টাকা করে পায় বিপিসির এ চার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
তবে বিপিসির দাবি, প্রতি বোতলে ৬৫ টাকা পরিবহন ব্যয় নির্ধারণ করা আছে। হিসাব অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে পরিবহন ব্যয় বাদেও প্রতি বোতল ৩০ টাকা করে প্রায় ১৬ কোটি টাকা লাভ করেছে চার প্রতিষ্ঠান।
বিগত আট বছরের মধ্যে মাত্র দুই বছর লাভের মুখ দেখলেও ছয় বছর বড় অংকের ব্যবসায়িক লোকসান গুনেছে এলপিজিএল। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ কোটি ২৩ লাখ ৫১ হাজার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯১ লাখ ৪ হাজার, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ কোটি ৫১ লাখ ১৬ হাজার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যবসায়িক লোকসান হয় এলপিজিএলের। এই সময়ের মধ্যে সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার এবং এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা লাভ হয় প্রতিষ্ঠানটির।
বেসরকারি খাতের ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজি গ্যাসের দাম প্রতি মাসে নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিইআরসি জুন মাসে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে ১৩৬৩ টাকা এবং সাড়ে ১২ কেজির এলপি গ্যাসের দাম ধরা হয় ১৪১৯ টাকা।
বিআরসি ঘোষিত বেসরকারি পর্যায়ে সিলিন্ডারপ্রতি সাড়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের মূল্যের চেয়ে সরকারি এলপিজিএলের গ্যাসের দাম বিপিসি নির্ধারিত দর অনুযায়ী ৭২৯ টাকা কম। এতে এলপিজিএলের ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজারজাত করা সরকারি ১৫ হাজার ২১৫ মেট্রিক টন এলপিজিতে কমপক্ষে ৮৮ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮শ টাকা কম আয় হয়েছে এলপিজিএলের। একই ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ হাজার ৫০১ টন এলপি গ্যাস বাজারজাত করে প্রায় ৭৩ কোটি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৪০১ টন বাজারজাত করে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা আয় কমে যায় কোম্পানিটির।
অভিযোগ রয়েছে, এলপিজিএলের সাড়ে ১২ কেজির এলপি গ্যাস ভোক্তা পর্যায়ে ৬৯০ টাকা বিক্রির কথা থাকলেও দেশের কোথাও তা কার্যকর নেই।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বেসরকারি এলপি গ্যাসের দামের চেয়ে সরকারি এলপি গ্যাসের দাম অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্তু সেই সুফল ভোক্তারা পান না। বেসরকারি এলপি গ্যাসের চেয়ে সরকারি এলপিজিএলের গ্যাসের দামে যে তারতম্য রয়েছে, সেই টাকার পুরোটাই অসাধু সিন্ডিকেট ভাগবাটোয়ারা করে।
এলপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, ‘আমরা উপজাত হিসেবে ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে এলপি গ্যাস পাই। এসব গ্যাস বোতলজাত করে আমরা বিপিসির চার বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও এসএওসিএলের নিয়োগ করা ঠিকাদারদের সরবরাহ করি। সব সিদ্ধান্তই বিপিসির নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখন এলপিজিএলের বটলিং প্রক্রিয়া অটোমেশন হচ্ছে। এতে কাজের সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি আরও বেশি লাভের মুখ দেখবে।’