ঢাকা
২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
বিকাল ৪:১৭
logo
প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০২৪

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচার, যা বলছেন আইনজ্ঞরা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালে হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এরই মধ্যে সাতটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের কর্মী হত্যা এবং বাকিগুলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে হত্যার শিকার ভিকটিম পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ। প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্ভব কি না।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত-বিএনপির নেতাদের বিচার হয়। পরে ছয়জনের দণ্ডও কার্যকর করা হয়। এখন একই ট্রাইব্যুনালে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য, আইনশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি উঠেছে। জমা পড়েছে অভিযোগ।

ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটির সঙ্গে কীভাবে কারা জড়িত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত এবং তথ্য-উপাত্ত সবকিছু আসার পরে না কোর্টে বলবে যে হ্যাঁ এটায় শাস্তি হতে পারে। মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কিন্তু মামলা হলেই সাজা হয়ে যাবে বিষয়টা তা নয়।- মনজিল মোরসেদ

এসব অভিযোগের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা অভিযোগ গ্রহণ করেছি। সাতটি মামলার তদন্তই একসঙ্গে হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে পাঠানো হবে।’

শেখ হাসিনাসহ বর্তমানে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে তাদের বিচার করা সম্ভব হবে কি না সেটি নিয়ে চলছে নানান আলোচনা। এই হত্যাকাণ্ড ‘গণহত্যা’ কিংবা ‘মানবতাবিরোধী’ হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি পাবে কি না সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন আইন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা অভিযোগ আমি এখনো দেখিনি। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সেটি সেখানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগটি গেছে সেটির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।- অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক

তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। আবার ভিন্নমতও আছে। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান আইনে নয়, বিচার করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে।

গত ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গণহত্যা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় বিচারের জন্য এরই মধ্যে কিছু মামলা হয়েছে। রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছে যে এটিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ আছে কি না। সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনার বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড স্পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট (সংশোধন ২০১৩) অনুযায়ী আইনে যেভাবে বর্তমানে আছে, সেটা যদি আপনারা দেখেন এবং হিসাব করেন তাহলে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল কী ধরনের বিচার করতে পারবে সেটি বলা আছে।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আছে সেই অভিযোগগুলো আসলেই আন্তর্জাতিক আইনে বিচার্য বিষয়। তাদের নির্দেশ ছিল দেখামাত্রই গুলি করে শেষ করে দেওয়া, এই যে নিঃশেষ করে দেওয়া এটি গণহত্যার মধ্যে পড়ে।-অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম

তিনি বলেন, ‘এখানে বলা আছে ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটির ব্যাপারে যে কোনো মামলা এখানে বিচার করা যাবে। এটিই হলো ব্যাখ্যা। সেখানেও যা আছে সেটাও অভিযোগ আনা যেতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা যাবে না বা আনতে পারবে না, আইনের ব্যাখ্যায় তা মনে হয় না।’

‘কিন্তু কথা হলো ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটির সঙ্গে কীভাবে কারা জড়িত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত এবং তথ্য-উপাত্ত সবকিছু আসার পরে না কোর্টে বলবে যে হ্যাঁ এটায় শাস্তি হতে পারে। শুধু অভিযোগ দায়ের করে মামলা করায় শাস্তি হবে না। মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কিন্তু মামলা হলেই সাজা হয়ে যাবে বিষয়টা তা নয়।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে জন্য। আইন সংশোধন না করে বর্তমান আইনে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করা যাবে না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো জনগোষ্ঠীকে যদি গুম করার জন্য, বিচ্ছিন্ন করার জন্য সরকার অবৈধ হস্তক্ষেপ করে বা অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে সেটি গণহত্যার মধ্যেই পড়বে। আর কোনো ঘটনা যদি গণহত্যার মধ্যে পড়ে তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা সম্ভব।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয় সেটা ছিল একটি গোষ্ঠীকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা। কাজেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সে ঘটনার বিচার হতে পারে।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছাত্র আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞ চালানোর অভিযোগে বিচার করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা অভিযোগ আমি এখনো দেখিনি। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সেটি সেখানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগটি গেছে সেটির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের যে আইনটি আছে সেটি শুধু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজাকারদের বিরুদ্ধে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই নয়, কোথাও যদি দেখা যায় গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে বা কারও নির্দেশে ঘটেছে তাহলে সেটার বিচারও করা যাবে। কারণ এটির নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সুতরাং এখানে যদি হত্যার শিকার ভিকটিম পরিবারের কেউ আইনের মধ্যে থেকে অভিযোগটি করেন তাহলে অবশ্যই বিচার করা যাবে। যে অভিযোগটি দায়ের করেছে সেটি ইনভেস্টিগেশন হবে তারপরে সেটি দেখা যাবে।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম থেকে সবাই পদত্যাগ করেছে এবং এর আগে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অবসরে চলে গেছেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সচল নয়। সেটির কী হবে- জানতে চাইলে রাষ্ট্রের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হয়তো নিয়োগ হয়ে যাবে শিগগির। প্রসিকিউশনও নিশ্চয় পূর্ণ গঠন করা হবে।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আছে সেই অভিযোগগুলো আসলেই আন্তর্জাতিক আইনে বিচার্য বিষয়। তাদের নির্দেশ ছিল দেখামাত্রই গুলি করে শেষ করে দেওয়া, এই যে নিঃশেষ করে দেওয়া এটি গণহত্যার মধ্যে পড়ে।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন টিম থেকে পদত্যাগকারী প্রসিকিউটর রাণাদাশ গুপ্ত বলেন, ‘যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তারা জেনে বুঝেই করেছেন। এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ‘আপাতত আইন সংশোধনের খুব বেশি প্রয়োজন নেই, বিচারের জন্য এ আইন যথেষ্ট। তবে আওয়ামী লীগ সরকার তো দলীয়করণ করে ফেলেছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করতে হবে। সেখানে দল নিরপেক্ষ, যোগ্য, মেধাবী বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। অনেস্ট ও সাহসী ব্যক্তিকে যুক্ত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা কোনো কিছুর বিনিময়ে বিক্রি হবে না।’

এ বিষয়ে অভিযোগ দায়েরকারী আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২(৩)(গ) ধারায় গণহত্যার সংজ্ঞা দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জনগণকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, যদি মানসিক নির্যাতন করা হয় তাহলে সেটি গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ। সারাদেশে যারা মারা গেছেন তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী-সমর্থক। তাদের টার্গেট করে মারা হয়েছে। এজন্যই এটা গণহত্যা হবে। এই আইন অনুযায়ী শেখ হাসিনাসহ অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে।’

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram