বাংলাদেশে গত ১৭ বছরে গুমের শিকার হয়েছেন ৬২৯ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া এসব মানুষের একটি বড় অংশই আর ফিরে আসেননি। দীর্ঘদিন অজ্ঞাত স্থানে রাখার পর যারা ফিরে এসেছিলেন, তারাও ‘টু’ শব্দটি করেননি; মুখে ছিপি এঁটে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বদলে যায় প্রেক্ষাপট। গুমের পর ‘আয়না ঘর’ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা তাদের নৃশংস নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি কমিশন গঠন করতে যাচ্ছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার আদালতের মাধ্যমে পুলিশ ও র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও স্বজনরা। সর্বশেষ, গত ১৪ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বলেন, গুমের শিকার হয়ে যারা ফিরে আসেননি, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া; যাতে গুম হওয়া ব্যক্তিরা ফিরে আসেন কিংবা তাদের জীবনে যা ঘটেছে, তা জানা যায়। এরই মধ্যে সরকার কমিশন গঠন করেছে। এটার মধ্য দিয়ে আশা করি যে বিষয়গুলো এখনো উদঘাটন হয়নি, সেই বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলেছে, ১৭ বছরে (২০০৭-২০২৩) গুমের শিকার হয়েছেন ৬২৯ জন। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৬২ জনকে। ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৮৩ জন। ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ৯৭ জন গুম হন।
আসকের পরিসংখ্যান বলেছে, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ২১ জন গুম হন। ২০১০ সালে ৪৭ জন, ২০১১ সালে ৫৯ জন, ২০১২ সালে ৫৬ জন, ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৫৫ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৬০ জন, ২০১৮ সালে ৩৪ জন, ২০১৯ সালে ১৩ জন, ২০২০ সালে ৬ জন, ২০২১ সালে ৭ জন, ২০২২ সালে ৫ জন ও ২০২৩ সালে ৯ জন গুমের শিকার হন।
আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির (ফরিদ) বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গণমাধ্যম ও নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা ৬২৯ জনের গুমের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। গুমের পর কিছু মানুষ ফিরে এসেছেন, কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আবার অনেকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৩ জন এখনো নিখোঁজ। নিখোঁজের অর্থ হচ্ছে তারা ফিরে আসেননি কিংবা ফিরে এলেও আমাদের কাছে তার তথ্য নেই।
মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, কমিশনের মূল দায়িত্ব হলো সত্য উদ্ঘাটন করা। গুম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। গুমকে যদি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কেউ ব্যবহার করে, সেটি আরো অনেক বড় অপরাধ। অভিযোগের দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এড়াতে পারবে না। যারা এ ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারলে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করার দুঃসাহস করবে না কেউ।
গত মঙ্গলবার কমিশন গঠন সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই),
প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইনপ্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে কমিশনটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের পাঁচই আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত করবে।
আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, বিনা বিচারে ক্রসফায়ারের অভিযোগ ছিল। কিন্তু ওই সময় সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকজন ব্যক্তি আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, মীর কাশেম আলীর ছেলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আহমেদ বিন কাশেম আরমান, পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা।
তিনজনই বলেন, তাদের যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, সেখানে সূর্যের আলো দূরের কথা, কোনো আলোই ছিল না। বেশিরভাগ সময় তাদের হাত বাঁধা ও চোখে পট্টি লাগানো থাকত।
স্বজনরা বলেন, ফিরে না আসা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের এটা জানার অধিকার আছে যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে আসলে কী হয়েছে। তাদের এটাও জানার অধিকার আছে যে, কারা এসব নির্যাতন ও হত্যাকা-ের নির্দেশদাতা; কতটি গোপন বন্দিশালা বাংলাদেশে আছে এবং কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসব গুমকা-ের সঙ্গে যুক্ত।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলির ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। সানজিদা বলেন, কোনো তথ্য যাতে গোপন করা না হয়, এটা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবেদন কমিশনের কাছে। আশা করব, এই স্বচ্ছতা আমাদের সাথে থাকবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে।
গত ১৮ আগস্ট প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা দেয় মায়ের ডাক।
ডিজিএফআইয়ের কার্যালয়ে গিয়ে এই তালিকা দিয়ে সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক কারণে ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত যত ব্যক্তিকে গুম ও খুন করা হয়েছে, তা তদন্ত করতে হবে। এসব ঘটনার সঙ্গে ডিজিএফআই, র্যাব, পুলিশ, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন ঘটনের পর প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়া এবং বিচারের আশায় মামলা করছেন স্বজনরা। মামলায় র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তাদের আসামি করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে গুম করার অভিযোগে ৮ বছর পর গতকাল বুধবার আদালতে মামলার আবেদন করেছেন তার স্ত্রী নাইস খাতুন। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি অভিযুক্ত করেছেন তৎকালীন র্যাব-৫ এর রেলওয়ে কলোনি ক্যাম্পে কর্মরত সাতজনকে। নাইসের অভিযোগ, তার স্বামী স্বর্ণ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করেছে র্যাব সদস্যরা। এখন আশা করছেন, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন। গত মঙ্গলবার যশোরের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) ও বর্তমান রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আনিসুর রহমান, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিকদার আক্কাস আলী ও উপপরিদর্শক আবু আনসারসহ পুলিশের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে। যশোর সদর উপজেলার কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের বিএনপিকর্মী মাসুদকে বাড়ি থেকে পুলিশের গাড়িতে তুলে গুম করার অভিযোগে ৯ বছর পর তার মামা কুদ্দুস আলী মামলাটি করেন। পরে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ওসি কোতোয়ালিকে নির্দেশ দেন আদালত। যশোরে রেজোয়ান নামের এক কলেজছাত্রকে অপহরণ ও গুমের অভিযোগে আট বছর পর তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন তার ভাই রিপন হোসেন। গতকাল বুধবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকিয়া সুলতানা বিচারক মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য বেনাপোল পোর্ট থানার ওসিকে আদেশ দিয়েছেন। মামলার আসামিরা হলেন- বেনাপোল পোর্ট থানার সাবেক ওসি অপূর্ব হাসান, ওসি (তদন্ত) খন্দকার শামীম আহমেদ ও এসআই নূর আলম।