শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে গাজীপুরে ক্রমাগত শ্রমিক অসন্তোষ লেগেই আছে। কারখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, দাবি আদায়ে নিত্যনতুন ইস্যু তৈরি করে মালিক পক্ষকে চাপ দিচ্ছেন শ্রমিকরা। আর শ্রমিকদের অভিযোগ, মালিকরা সরকারের পক্ষালম্বন করে শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এখন বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে তারাও তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের এসব দাবি অনেক পুরোনা। এখন নতুন করে এসব দাবি সামনে আনা হয়েছে।
অনেকে শিল্পখাতকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করছে বলেও শিল্প মালিকরা অভিযোগ করেন। নানা কারণে এসব অসন্তোষ থামাতে আইনশৃংখলা বাহিনী কঠোর হতে পারছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়াসহ বিভিন্ন স্থানে কারখানায় পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেন পুরুষ শ্রমিকরা। তাদের দাবি বিভিন্ন কারখানায় কেবল নারী শ্রমিকদের চাকরি দেওয়া হয়। পুরুষ শ্রমিকদের চাকরি দেওয়া হয় না। তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিকদেরও চাকরি দেওয়ার দাবি জানান।
‘পরিকল্পিতভাবে পরাজিত অপশক্তির ইন্ধনে একটি চক্র এসব অস্থিরতা সৃষ্টি করছে’
চাকরিচ্যুত শ্রমিক আবুল বাশার বলেন, তিনিসহ আরও বেশ কয়েকজন একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। তুচ্ছ ঘটনায় সাতজনের চাকরি চলে যায়। পরে জানতে পারেন ওই সাতজন পুরুষের স্থানে সাতজন নারী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমন নানা অযুহাতে পুরুষ শ্রমিকদের বাদ দিয়ে নারী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এতে পুরুষ শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারখানা মালিক অভিযোগ করেন, নানা অযুহাতে কিছু সংখ্যক শ্রমিক কারখানাগুলোতে পরিকল্পিতভাবে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। অযৌক্তিক দাবি নিয়ে মালিকদের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমরা পুলিশ ডেকেও যথা সময়ে পাচ্ছি না। বিশৃংখলার কারণে আমাদের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে পণ্যের অর্ডার সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি এ অবস্থার দ্রুত অবসান চান।
বিএনপি সমর্থক এক শিল্প মালিক বলেন, গত ১৫ বছর ধরে যেসব দাবি আমরা শুনিনি এখন সেসব দাবি করা হচ্ছে। আমার কারখানায় আমি পুরুষ শ্রমিক নেব না নারী শ্রমিক নেব সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এখন এখানেও বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে পরাজিত অপশক্তির ইন্ধনে একটি চক্র এসব অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এদের প্রতিহত করার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। তা না হলে শিল্পে উৎপাদন কমে যাবে।
তবে এসব বিষয়ে শিল্প ও থানা পুলিশ বলছে, কারখানার মালিক ও শ্রমিক পক্ষের দাবি দাওয়াগুলো তাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। এখানে শিল্প পুলিশ মধ্যস্থতা করতে পারে। তবে আইনশৃংখলা অবনতি হলে সেটা পুলিশ দেখে থাকে। আর মহাসড়ক অবরোধের ফলে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হলেও পরিবর্তীত সময়ে এখন পুলিশ কোনো অ্যাকশনে যেতে পারছে না।
২১ দফা দাবিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর এলাকায় স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেড নামের ওষুধ তৈরি কারখানার শ্রমিকরা গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে টায়ার ও আবর্জনায় আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেন।
কারখানার শ্রমিকরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে বৈষম্য করে আসছে। এসব বৈষম্যের প্রতিবাদে এবং ২১ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
শ্রমিকদের দাবিগুলো হচ্ছে- অফিস চলাকালীন এবং অফিসে যাতায়াতকালীন যদি কোনো কর্মী দুর্ঘটনার শিকার হয় তাহলে তার সম্পূর্ণ চিকিৎসা খরচ কোম্পানি বহন করবে। সঙ্গে ওই কর্মীকে কোম্পানির এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। কারখানার এইচআরডি এজিএম সুরজিৎ মুখার্জি এবং প্রোডাকশন সিনিয়র ম্যানেজার দিপালক কর্মকার, সিনিয়র ম্যানেজার জাহিদুর রহমান, এইচ আর ডি সাম্মি আক্তার ও রুহুল আমিনকে পদত্যাগ করতে হবে। ছুটির জন্য হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। নন ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের সঙ্গে সর্বদা সহনশীল সদাচরণ করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কোনো কর্মীকে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকার হয়রানি বা চাকুরিচ্যুত করা যাবে না। কোনো প্রকার বৈষম্যমূলক এবং অপমানজনক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করা যাবে না। এছাড়াও কর্মীদের সঙ্গে সিকিউরিটি গার্ডদের উত্তম আচরণ করতে হবে। প্রতি দুই বছর পর পর সকল পারমানেন্ট কর্মীদের গ্রেড উন্নয়ন করতে হবে। মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করতে হবে। সঙ্গে ছুটি কালীন সময়ে সম্পূর্ণ বেতন এবং ভাতা প্রদান করাসহ ২১ দফা দাবি জানানো হয়।
কারখানার শ্রমিক সফিকুল ইসলাম বলেন, দাবিগুলো আগে থেকেই ছিল কিন্তু আগে আমরা কথা বলতে পারিনি। এখন সময় এসছে এসব নিয়ে কথা বলার। তাই দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমেছি।
ওই কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের এজিএম সুরজিৎ মুখার্জি জানান, শ্রমিকদের দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
একই দিনে প্রতিমাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ, বেতন বৃদ্ধি ও চাকরি স্থায়ীকরণসহ ১৬ দফা দাবিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার কারলসুরিচালা এলাকায় জেনারেল ওষুধ তৈরি কারখানায় শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছেন। তারা সফিপুর-বড়ইবাড়ি আঞ্চলিক সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেন।
কারখানার শ্রমিক ইকবাল হোসেন জানান, উপজেলার কারলসুরিচালা এলাকার জেনারেল ফার্মাসিউটিকাল লিমিটেড কারখানায় শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে প্রতিমাসেই তালবাহানা করে বিলম্ব করে আসছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের বেতনও বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। সবমিলিয়ে ১৬টি দফা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে সকালে শ্রমিকরা কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময়ে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে সফিপুর-বড়ইবাড়ি আঞ্চলিক সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
‘নানা অযুহাতে পুরুষ শ্রমিকদের বাদ দিয়ে নারী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এতে পুরুষ শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে’
কারখানা শ্রমিক রহিমা খাতুন বলেন, আমাদের বেতন কোনো মাসেই সঠিক সময়ে দেয় না। বেতন নিয়ে নানা তালবাহানা করে। আমাদের বাসা ভাড়া দিতে হয়, দোকানে বাকি পরিশোধ করতে হয়। সেগুলো সময় মতো দিতে না পেরে তাদের কথা শুনতে হয়। আমাদের বেতন বাড়াতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের সময় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ছুটির সময়ের বেতন দিচ্ছে না।
কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
এ বিষয়ে গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক নিতাই চন্দ্র বলেন, শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতা করে কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এলাকার শান্তিশৃংখলা বজায় রাখার জন্য শিল্প পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।
অপরদিকে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে সোমবার বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের কারণে ১১টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময়ে ওইসব কারখান থেকে যেসব শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হন তারা এ ভাঙচুর করেছেন বলে জানিয়েছেন ওইসব কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তারা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকালে নিজ নিজ কারখানায় কাজে যোগ দেন টঙ্গীর বিসিক এলাকার সব পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চাকরিচ্যুত কয়েকশ শ্রমিক কয়েক ধাপে ১১টি পোশাক কারখানার গেটে অবস্থান নেন। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানায় তারা। এ সময় কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা তাদের ডাকে সাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা ওই ১১টি কারখানায় ভাঙচুর চালান। নিজ কারখানায় ভাঙচুর ঠেকাতে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে ভাঙচুর এড়াতে ওই কারখানাগুলোতে ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ সময় চাকরিচ্যুত অন্তত দুজন শ্রমিক আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
ছুটি ঘোষণা করা কারখানাগুলো হলো- টঙ্গীর বিসিক এলাকার লিমিটেড টসি নিট ফেব্রিক্স লিমিটেড, ন্যাশনাল কম্পোজিট লিমিটেড, পেট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেড, বেলিসিমা অ্যাপারেল্স লিমিটেড, জিন্স এন্ড পোলো লিমিটেড, টেঙ্গন গার্মেন্টস লিমিটেড, রেডিসন গার্মেন্টস লিমিটেড, সুমি অ্যাপারেলস লিমিটেড, আরবিএস গার্মেন্টস লিমিটেড, গার্ডেন টেক্সটাইল লিমিটেড ও তাজকিয়া অ্যাপারেলস লিমিটেড।
দুপুর দুইটার দিকে কারখানাগুলোতে ছুটি ঘোষণা করলে চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা টঙ্গীর বিসিক এলাকার পানির ট্যাঙ্কি এলাকার শাখা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। বিকেল তিনটা পর্যন্ত চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা সেখানে অবস্থান করেন। এতে ওই সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
চাকরিচ্যুত শ্রমিক মো. রমজান হোসেন বলেন, কারখানাগুলোতে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিভিন্ন কারখানার চাকরিতে থাকা শ্রমিকদের আমাদের আন্দোলনের যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। আমরা সড়কে বসে অবস্থান করছি। দাবি না মেনে নিলে কোনো গার্মেন্টসে শ্রমিকদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।
তাজকিয়া অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (মানবসম্পদ) হেমায়েত উদ্দিন বলেন, সকালে বহিরাগতরা কারখানার সামনে জড়ো হয়ে কারখানার প্রধান ফটকে ভাঙচুর চালায়। ভাঙচুর ও ক্ষতি এড়াতে কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছি।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন বলেন, চাকরিতে বৈষম্য ও পুরুষ শ্রমিকদের নিয়োগে অগ্রাধিকারের দাবি জানিয়ে কয়েকশ চাকরিচ্যুত শ্রমিক ১১টি কারখানায় ভাঙচুর চালায়। বিক্ষুব্ধরা টঙ্গীর বিসিকের একটি সড়কে অবস্থান নেন।
তিনি বলেন, গাজীপুরে বেতনভাতা দিতে দেরি হওয়াসহ নানা অভিযোগে কারখানার শ্রমিকরা সড়কে নেমে আসেন। তাদেরকে আমরা বুঝিয়ে শুনিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিই। মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করি। এখন নতুন নুতন অনেক ইস্যু নিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে।