দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার ৫২০ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। বাড়তি এই সক্ষমতা দেশের অর্থনীতির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বসিয়ে রাখা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
এতে বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ, দাম বাড়িয়ে যা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৩টি আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ও ৩০টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে প্রায় এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সামিট গ্রুপ। কম্পানিটি ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভাড়া পেয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল সাত কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে আট হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ইউনাইটেড গ্রুপ ছয়টি কেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সাত হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কম হতে পারত।
২০১০ সালে দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ নামে একটি আইন করে সরকার।
গত ১৪ বছরে বেসরকারি খাতে ১০০টিরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সব কেন্দ্রই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংক্রান্ত বিশেষ আইনে অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১০ সাল থেকে অনুমোদন দেওয়া ছোট-বড় এসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো দায়মুক্তি আইন পাস করে বিচারের পথ রুদ্ধ করেছে সরকার।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির বিশেষ বিধান আইনের অধীনে চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য মতে, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর গত ১৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে শতাধিক বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত তিন লাখ ১৮ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে এ সময়ে আনুমানিক ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হতে পারে। এটি বিবেচনায় নিলে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে মোট প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। পাশাপাশি ভারত থেকেও বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ বছরে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে বিপিডিবিকে। এর মধ্যে শেষ দুই অর্থবছরে (২০২১-২২ ও ২০২২-২৩) ৮৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত সক্ষমতা নিয়ে সম্প্রতি এক প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, ব্যবহার করা না গেলেও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে? আওয়ামী লীগ সরকার এখন যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে, তা ২০৩০ সালেও প্রয়োজন হবে না। ছয় বছর পর চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৯ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২৫ শতাংশ রিজার্ভ ধরলে তখন ২৩ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা হলেই চলবে। অতিরিক্ত সক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দিতে হচ্ছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘প্রায় দেড় দশকে দ্রুত বিশেষ আইনের আওতায় এনে অনুমোদন দেওয়া হয় অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, যা এখন বিদ্যুৎ খাতের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেছেন, ২০১২ সাল থেকে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিজের স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করেছে তৎকালীন সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার)। কেন্দ্রগুলো বিশেষ আইনের আওতায় বাস্তবায়ন না হলে এর ব্যয় কম হতো অন্তত ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় দেখানোয় দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ পড়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ আইনের কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হয়নি। বিশেষ করে এই খাতে যে অনিয়মন ও দুর্নীতি হয়েছে, তা নতুন কিছু নয়। আমরা সবাই জানি, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার হতে হবে। নতুন সরকার এসেছে। এই খাতে নীতি ও কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে।’