পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আলোচিত বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে কারসাজি পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির তদন্তে শেয়ারটির কারসাজিতে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা হলে আব্দুর রউফ, ক্রিসেন্ট লিমিটেড, মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেয়ার অ্যাসোসিয়েটস, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড, মারজানা রহমান ও ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত বেক্সিমকোর শেয়ারের টার্নওভার মূল্য ছিল চার হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে ভিন্ন ভিন্ন ক্লায়েন্ট কোডের মাধ্যমে যার ৭০ শতাংশের বেশি লেনদেন করেছে এই আট বিনিয়োগকারী।
তদন্তে দেখা গেছে, গ্রুপটি যৌথভাবে রিয়ালাইজড গেইন করেছে ২১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং আনরিয়ালাইজড গেইন করেছে ৫২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০২২ সালের শেষের দিকে ডিএসইর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে জমা দেওয়া হয়।
এরপর প্রতিবেদনটি শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনে আটকে যায়। কারণ কম্পানিটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন এবং কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত কম্পানিগুলোও তাঁরই মালিকানাধীন।
কম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে—ক্রিসেন্ট লিমিটেড, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল।
২০২০ সালের ১৯ মার্চ বেক্সিমকোর শেয়ার দর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা, যা ওই বছরের শেষ দিকে ২২ টাকায় লেনদেন হয়। তার পর থেকে শুরু হয় শেয়ারটির রেকর্ড কারসাজির গল্প। দুই মাসের মাথায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দাম ওঠে ১০০ টাকায়।
এরপর একই বছরের শেষ দিকে দাম তোলা হয় প্রায় তিন গুণ ১৯০ টাকায়। এই সময় দেখানো হয় রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা। ঘোষণা করা হয় বড় আকারে ডিভিডেন্ড।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২০২২ সালের শুরুর দিকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দামে কারসাজি করে আট বিনিয়োগকারীর একটি গ্রুপ ৮৪৬ কোটি টাকা রিয়ালাইজড ও আনরিয়ালাইজড গেইন করেছে।
চার ব্যক্তি ও চার প্রতিষ্ঠানের দলটি সক্রিয় লেনদেনের ভুয়া ধারণা সৃষ্টি করতে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে কৃত্রিমভাবে ধারাবাহিক লেনদেনের মাধ্যমে শেয়ারের দাম স্ফীত করেছে, যার বেশির ভাগই হয়েছে নিজেদের মধ্যে লেনদেনের মাধ্যমে।
২০২২ সালে জুপিটার বিজনেস এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেডের শেয়ার অধিগ্রহণের পর এটির বোর্ডে যুক্ত হয়। দুটি কম্পানি ফারইস্টের বোর্ডে তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য বেক্সিমকো গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের মনোনীত করে।
ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল বেক্সিমকো গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা জামানুল বাহারকে মনোনীত করে। অন্যদিকে জুপিটার বিজনেস বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা আলী নওয়াজ ও বেক্সিমকো টেক্সটাইলের জেনারেল ম্যানেজার মাসুম মিয়ার নাম সুপারিশ করে।
এরপর বিএসইসি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের জন্য ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনালকে একটি সতর্কতামূলক চিঠি দেয়। চিঠিতে কম্পানির ঠিকানা উল্লেখ করা হয় প্যারামাউন্ট হাউস, সপ্তম তলা, পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে। যেখানে বর্তমানে কম্পানিটির কোনো অস্তিত্ব নেই।
এদিকে সিকিউরিটিজ বিধি লঙ্ঘন ও কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ থাকা আব্দুর রউফ নিজেকে বেক্সিমকো গ্রুপের একজন কর্মচারী এবং গ্রুপের ইনস্যুরেন্স কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন বলে দাবি করেন।
শেয়ার কারচুপির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। শুধু কম্পানির লোকেরাই এ বিষয়ে আরো তথ্য দিতে পারবে।’
কম্পানির নামে খোলা বিও হিসাব অনুযায়ী আব্দুর রউফকে ক্রিসেন্ট লিমিটেডের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় কিছু নথিতে আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, তবে আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ধারা ১৭-এর বেশ কয়েকটি উপধারা লঙ্ঘন করেছে। ধারা ১৭ লঙ্ঘন অনুযায়ী এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ।