কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া একনেক সভায় ওঠানো যায় না। এ সুযোগ নিয়ে নিজ এলাকার জন্য বহু প্রকল্প পাস করিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীরা। একইভাবে শেখ পরিবারের সদস্যদের কারও নামে কোনো প্রকল্প নিলেই সেটার প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই ‘অটোপাস’ করানো হতো।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়-বিভাগগুলো প্রত্যেক প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) আকারে পাঠায়। ডিপিপি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব থাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের। প্রত্যেক সদস্য সচিব পদমর্যাদায় দায়িত্বরত। এসব সদস্য চাইলেই প্রকল্পের ডিপিপি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় সংশোধনের প্রস্তাব করতে পারেন অথবা পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে এগুলো বাদ দিতে পারেন। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া কোনো প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশনের একনেক সভায় ওঠানো যায় না। এ সুবিধা নিয়ে দায়িত্বকালীন একাধিক প্রকল্প অনুমোদন করিয়েছে নিয়েছেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও এম এ মান্নান।
দেশব্যাপী কতিপয় জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেয় আইসিটি বিভাগ। প্রকল্পের ডিপিপিতে তখন কুমিল্লা জেলার নাম ছিল না। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শর্ত জুড়ে দেন কুমিল্লা জেলাকে প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলেই কেবল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হবে। পরে প্রকল্পের ডিপিপি পুনরায় সংশোধন করে কুমিল্লা জেলার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর পরেই প্রকল্পের অনুমোদন দেন সাবেক এ মন্ত্রী।
জানা যায়, শেখ পরিবারের নাম থাকলেই প্রকল্প সহজে পাস হতো একনেক সভায়। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি থাকার পরও অনেক প্রকল্প প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রভাব খাটিয়ে ও শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে নিজ এলাকায় ‘শেখ হাসিনা নকশিপল্লি, জামালপুর (প্রথম পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন বলে জানা যায়। যদিও প্রকল্পের ৭৭২ কোটি টাকা বিফলে যাবে বলে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
সব সময় প্রকল্পের মেরিট দেখে যাচাই-বাছাই করা দরকার। কারণ জনগণের টাকায় জনগণের কল্যাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। এখানে অন্য কোনো ক্রাইটেরিয়া থাকা বা দেখার সুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখছি অর্থনৈতিক মেরিট না দেখে রাজনীতিবিদদের চেহারা দেখে প্রকল্প অনুমোদন হয়।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সব সময় প্রকল্পের মেরিট দেখে যাচাই-বাছাই করা দরকার। কারণ জনগণের টাকায় জনগণের কল্যাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। যে প্রকল্পে বেশি বেনিফট হবে সেই প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এখানে অন্য কোনো ক্রাইটেরিয়া থাকা বা দেখার সুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখছি অর্থনৈতিক মেরিট না দেখে রাজনীতিবিদদের চেহারা দেখে প্রকল্প অনুমোদন হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি উচ্চ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে প্রকল্প নেওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অথচ এটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটা এক ধরনের দুর্নীতি, এটা বন্ধ হওয়া জরুরি।’
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর সুনামগঞ্জে প্রকল্পের হিড়িক
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুনামগঞ্জে ১০৮টি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ছিল। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান নিজ এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। নির্বাচনী এলাকায় রাস্তা-ঘাট-মসজিদ-মন্দির-মাদরাসার উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালের আসন বৃদ্ধি, দুই উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, দুই উপজেলা সড়কে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, অধিকাংশ এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন। এমন অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে মন্ত্রীর এলাকায়। প্রকল্পের সংখ্যা বেশি হলেও এমএ মান্নানের অধিকাংশ প্রকল্প ছিল জনমুখী।
প্রকল্প নিলেই নিজ জেলার নাম দেখতেন মুস্তফা কামাল
কুমিল্লা-১০ আসনের সদর দক্ষিণ, লালমাই, নাঙ্গলকোট এলাকা নিয়ে সাবেক পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্বাচনী এলাকা। এ এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শিল্পসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন তিনি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েরও হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। এছাড়া কুমিল্লা ইপিজেড ঘিরে অন্তত দুই লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে এবং গড়ে উঠছে পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণ। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। লালমাই ও সদর দক্ষিণ উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে আইটি পার্ক স্থাপনে জায়গা অধিগ্রহণের কাজ শেষ। এছাড়া নারীদের জন্য আরও একটি আইটি পার্ক স্থাপন হয়েছে। লালমাই ময়নামতি পাহাড়ি জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সাড়ে ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান। মূলত পরিকল্পনামন্ত্রী থাকার কারণে একাধিক প্রকল্প নিজ এলাকায় পাস করিয়ে নেন মুস্তফা কামাল। তিনি সব সময় নিজ প্রকল্পের মধ্যে নিজ জেলা আছে কি না সেটায় গুরুত্ব দিতেন।
শেখ পরিবার নাম থাকলেই প্রকল্প অনুমোদন
প্রভাবশালীদের চাপে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এ প্রকল্পগুলো যাতে সহজে পাস করানো যায়, সেজন্য কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিল শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম। শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে সরকারি টাকায় ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছিল সদ্য পদত্যাগ করা আওয়ামী লীগ সরকার। যাতে ব্যয় হচ্ছে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ, বাকি ৪৪ প্রকল্পের কাজ চলছে।
প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল বিনোদন কেন্দ্র, সাফারি পার্ক, দৃষ্টিনন্দন ভবন, নভোথিয়েটার, আইসিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠার নামে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ছেলে শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের নামে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নামে আরও ৪৩টি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। তার আগে সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া ৮২ প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্প থেকে।
এখন করণীয় এ ধরনের প্রকল্প পুনরায় রিভিউ করে বাতিল করা। এডিপি পুনর্বিবেচনা করে দেখা উচিত। রাজনৈতিক প্রকল্প পরিহার করে ঢেলে সাজানো উচিত এডিপি। কাজটা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে হবে। অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে হবে।- ড. মুস্তফা কে মুজেরী
পদত্যাগ করার তিন মাস আগে একটি একনেক সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের নামে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম না দিতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, নিজের নাম ব্যবহার করে যাতে আর প্রকল্প না নেওয়া হয়। তবু নাম দেওয়া থামেনি।
অতি উৎসাহী প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে প্রকল্প নিয়েছিলেন। সরকারি নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা যায়।
শেখ পরিবারের নামে ৫১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৮২ প্রকল্প নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিলে জনগণ উপকৃত হবে। অথচ এখানে প্রকল্পের মানদণ্ড বিচার না করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমি বলবো এটা জনগণের টাকার অপচয় ছাড়া কিছু নয়। প্রকল্পের অর্থের টাকা জনগণের পকেট থেকে আসে। অথচ স্বেচ্ছাচারিতার মতো করে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। জনগণের অর্থের প্রকল্প জনগণের কল্যাণে যদি না হয় সেটা দুর্ভাগ্য।’
বর্তমানে করণীয় প্রসঙ্গে ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘এখন করণীয় এ ধরনের প্রকল্প পুনরায় রিভিউ করে বাতিল করা। এডিপি পুনর্বিবেচনা করে দেখা উচিত। রাজনৈতিক প্রকল্প পরিহার করে ঢেলে সাজানো উচিত এডিপি। কাজটা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে হবে। অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে হবে।’
শেখ হাসিনার নামে ২০১৭ সালে যশোরে একটি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল ৩০৫ কোটি টাকা। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে এই পার্ক করা হয়, তা পূরণ হয়নি। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। শেখ কামালের নামে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর উদ্বোধন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১১৭ কোটি টাকা। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ইনকিউবেটরটি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। অনেকটা ‘অব্যবহৃত’ পড়ে আছে সুরম্য ভবন, কম্পিউটার ও ডরমিটরি। সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে প্রকল্প নিয়ে বিনা প্রশ্নে তা বাগিয়ে নেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নামে হাইটেক পার্ক, শেখ কামালের নামে আইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউটসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন করে নেন। যদিও এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই কাজে আসছে না। জনগণের টাকার অপচয় হচ্ছে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বৈঠকে তিনি বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এখানে কোনো জবাবদিহি নেই। এক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, মেগা প্রকল্প বা বড় প্রকল্পের বিষয়ে কোনো নীতি নেই। এগুলো নির্ভর করবে করবে কোন পর্যায়ে আছে। প্রকল্পের বিষয়ে সময় একটা বড় জিনিস। কিছু খরচ হয়ে গেলেই প্রকল্প শেষ করতে হবে বিষয়টা এমন না। প্রকল্পে লাভ-ক্ষতি দেখতে হবে। এটা অর্থনীতির যুক্তিতে চলে না।