জসিম সিদ্দিকী, কক্সবাজার: কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এতে নতুন করে আবারও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দুই দেশের দালালরা সহযোগিতা করছেন বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে দুই পাড়ে আছে দুই শতাধিক দালাল। তাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে হেঁটে নাফনদীর ওপারের তীরে আসেন রোহিঙ্গারা। সেখানে নৌকা নিয়ে বসে থাকেন দালালরা। এপারে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তেও থাকেন দালালরা। রাতে তারা টাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের ঢুকিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশে।
উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতের বেলা মংডু টাউনশিপের সুদাপাড়া, ফয়েজীপাড়া, সিকদারপাড়া ও নুরুল্লা পাড়া গ্রাম থেকে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছেন। নাফ নদীর সীমান্তে কিছু দালাল চক্রের সদস্যরা আবারও নৌকায় করে রোহিঙ্গারা শাহ পরীর দ্বীপ, ঘোলার চর, জালিয়া পাড়া, সাবরাং, নয়া পাড়া, টেকনাফের জাদিমুড়া, নাইট্যংপাড়া, বড়ইতলি, কেরুনতলি ও বাহারছড়া ইউনিয়নের সাগর উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নিয়ে দেশে আসছেন।
উখিয়া পাংলাখালী ইউপি চেয়ারম্যান এমএ গফুর চৌধুরী জানান, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে না থাকার সুযোগে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছেন। মূলত সীমান্তে কিছু দালাল জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে ঢুকতে সহযোগিতা করছেন। গত এক সপ্তাহে উখিয়া সীমান্ত দিয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন। উখিয়া পালংখালী সীমান্তে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার অপেক্ষায় রয়েছেন।
টেকনাফ সাবারাং ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসেন বলেন, দিনে রোহিঙ্গারা সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করেন। রাতে দালালের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। প্রতিদিন কমবেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছেন।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সদস্য নজির আহমদ বলেন, এক সপ্তাহে টেকনাফ সীমান্তে দিয়ে ৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে করেছেন। কেরনতলি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় আমি শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেছি।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত সাত-আট দিনে ১৪ হাজার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মংডু সীমান্তে জড়ো হয়েছে আরও ৬০-৭০ হাজার রোহিঙ্গা। নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। তবে এ বিষয়ে বিজিবি ও কোষ্টগার্ডের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক দিন ধরে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের চলমান যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। গেল রবিবার সন্ধ্যা থেকে আজ সোমবার বিকাল পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে। মংডু টাউনে থাকা সেনা ও বিজিপির দুটি ব্যারাক (ব্যাটালিয়ন) দখলের জন্য মরিয়া আরাকান আর্মি। গোলাগুলির পাশাপাশি দুই পক্ষ থেকে ছোড়া হচ্ছে মর্টার শেল, গ্রেনেড-বোমা। মাঝেমধ্যে ড্রোন হামলাও চালানো হচ্ছে।
মংডু টাউনের পাশে লাগোয়া পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, উকিলপাড়া, নুরুল্লাপাড়া দখল করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। মংডুসহ আশপাশের রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আদনান চৌধুরী বলেন, গত কয়েক দিনে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য আমরা পেয়েছি। বিজিবি ও কোস্ট গার্ডকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন বলেন, উখিয়া-টেকনাফের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবর আমরা পেয়েছি। তবে এ পর্যন্ত কতজন ঢুকেছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই।
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে নতুন করে আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনী লড়াইয়ে রোহিঙ্গারা নির্মূল হচ্ছে। লড়াই বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছেন।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মায়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।