পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য। বিগত সরকারগুলো ক্ষতিকর পলিথিন ও প্লাস্টিক বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় পরিবেশদূষণ রোধ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সব সরকারি অফিসে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।
এরপর ১৭টি সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের তালিকা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোতে পলিথিন শপিং ব্যাগ ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ না রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে তিন হাজার টন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ওয়েস্ট কনসার্নের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ৩৬ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা হয়।
আর ৩৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে যায় এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়। রাজধানী ঢাকায়ই প্রতিদিন প্রায় ৭০০ টন বা তারও বেশি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ঢাকার ড্রেন, জলাভূমি, খাল, নদী ও পরিত্যক্ত স্থানে জমা হয়। এসব বর্জ্য পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনার অভাবে নির্বিচারে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারণে শহর অঞ্চলের খালগুলোর পাশাপাশি নদীগুলোর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পরিবেশদূষণ রোধ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, বিক্রয়, ক্রয়, আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করে সরকার। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সংশোধনী এনে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, বিক্রয়, ক্রয়, আমদানি, রপ্তানি নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়। এরপর পলিথিনের ব্যবহার কিছুটা কমলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে আবারও ফিরে আসে পলিথিন। পলিথিনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের অপরিকল্পিত ব্যবহার এখন সারা দেশে উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পলিথিন ও প্লাস্টিকের ভয়াবহ বিস্তার নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি পলিথিন ও প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার কর্মসূচিতে রেখেছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে ১৫ আগস্ট জারীকৃত এক পত্রের মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণে সচেতনতা তৈরি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সচিবালয়কে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক মুক্ত ঘোষণার উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সব সিনিয়র সচিব, সচিব, বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় প্লাস্টিকের ফাইল, ফোল্ডারের পরিবর্তে কাগজ বা পরিবেশবান্ধব অন্যান্য সামগ্রীর তৈরি ফাইল ও ফোল্ডার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। প্লাস্টিকের পানির বোতলের পরিবর্তে কাচের বোতল ও কাচের গ্লাস ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিকের ব্যানারের পরিবর্তে কটন ফেব্রিক, জুট ফেরিক বা বায়োডিগ্রেডেবল উপাদানে তৈরি ব্যানার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। দাওয়াতপত্র, ভিজিটিং কার্ড ও বিভিন্ন ধরনের প্রচারপত্রে প্লাস্টিকের লেমিনেটেড পরিহার করতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সররাহকৃত খাবারের প্যাকেট কাগজের বা পরিবেশবান্ধব হয়, সেটি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস, কাপ, স্ট্র কাটলারিসহ সব পণ্য পরিহার, প্লাস্টিকের কলমের পরিবর্তে পেন্সিল বা কাগজের কলম ব্যবহার এবং বার্ষিক প্রতিবেদনসহ সব ধরনের প্রকাশনায় লেমিনেটেড মোড়কও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সব কর্মসূচিতে প্লাস্টিকের পানির বোতল বন্ধ করে পানির জগ ও গ্লাস রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোও এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বাংলাদেশ সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১ অক্টোবর থেকে দেশের সুপারশপগুলোতে পলিথিন শপিং ব্যাগ ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা এর সামনে পাট ও কাপড়ের তৈরি ব্যাগ রাখতে হবে। এ বিষয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হবে। পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এই কাজে তরুণ বা শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে।
এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বেসরকারি সংগঠন এসডো ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি বা পাটবস্ত্রের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপারশপের কর্তৃপক্ষ ও উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা ও সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করবেন।
পলিথিন ও প্লাস্টিকের অপরিকল্পিত ব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘সবাই দোকান থেকে পলিথিন ব্যাগ কিনে আনেন। আমরা কেউ বলি না পলিথিন ব্যাগ দিচ্ছেন কেন, এটা তো নিষিদ্ধ। আমরা হাতে করে নিয়ে আসি। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। অফিস-আদালত ও বাজারঘাটের পাশাপাশি প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, সমুদসৈকত কুয়াকাটা এবং ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে জরুরি ভিত্তিতে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।