পদ্মা সেতু পরিচালনা ও টোল আদায়ে পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মীরাও দায়িত্ব পালন করছেন। ঝড়-বৃষ্টি, খরতাপ, উৎসব-পার্বণেও বিরামহীন কাজ করছেন তাঁরা। এই কর্মীরা নিয়োগ পেয়েছেন টেলিটেল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের মাধ্যমে। ফলে সেতু কর্তৃপক্ষ এই কর্মীদের যে বেতন দেয় তা থেকে অন্তত ৭০ শতাংশ বেতন কেটে লুটে নিচ্ছে টেলিটেল কমিউনিকেশনস।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ একজন টোল কালেক্টরকে প্রতি মাসে বেতন দেয় ৬৪ হাজার টাকা। কিন্তু টোল কালেক্টররা চাকরির শুরুতে টেলিটেল থেকে বেতন পান মাত্র ১৪ হাজার টাকা। এরপর তাঁদের বেতন দেওয়া হয় ১৬ হাজার টাকা। বর্তমানে যাঁদের চাকরির বয়স দেড় থেকে দুই বছর তাঁরা বেতন পাচ্ছেন ২২ হাজার টাকা।
আর এক থেকে দেড় বছর যাঁদের চাকরির বয়স তাঁরা বেতন পাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা। বেতন শিটেও সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বেতন উল্লেখ আছে। কিন্তু বেতনের কলাম গোপন রেখে স্বাক্ষর নেওয়া হয় কর্মীদের। পদ্মা সেতুতে বর্তমানে টোল কালেক্টর পদে কাজ করছেন ৪৪ জন কর্মী।
এর মধ্যে নারী আছেন ১২ জন। চাকরির শুরুতে প্রতিজন টোল কালেক্টরের বেতন থেকে ৫০ হাজার বা ৭৮.১৩ শতাংশ টাকা লুটে নিচ্ছে টেলিটেল। এতে প্রতি মাসে ২২ লাখ টাকা এবং বছরে দুই কোটি ৬৪ লাখ লাখ লুটে নেওয়া হচ্ছে টোল কালেক্টর পদের কর্মীদের বেতন থেকে। একইভাবে টোল ম্যানেজার, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ, পিসি ম্যানেজমেন্ট, ট্রাফিক মনিটরিং কন্ট্রোলার, টোল ক্লিনারসহ বিভিন্ন পদের ১৩০ জন কর্মীর বেতনের টাকা থেকেও বিপুল অঙ্কের টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে।
কম বেতনে কর্মী নিয়োগ করতে গিয়ে নির্ধারিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টিও অনুসরণ করেনি টেলিটেল।
আবার অল্পশিক্ষিত অনেকে কাজ করছেন বড় পদে। এতে টোলের টাকা আদায়ে নানামুখী সমস্যা হচ্ছে।সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তদন্ত করে বিষয়টি দেখা হবে।’
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বলেন, ‘কর্মীদের বেতন কম দেওয়ার বিষয়ে কিছু অভিযোগ এসেছে। এ জন্য টেলিটেলকে বেতন স্টেটমেন্ট পাঠাতে বলেছি। এর আগেও তাদের কাছে বেতন স্টেটমেন্ট চাওয়া হয়েছিল। এরপর তারা কিছু তথ্য দিয়েছিল, কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ ছিল।
জানা গেছে, কম বেতনে সংসার চালাতে না পেরে অনেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আবার বেশি বেতনের অনেক কর্মীকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছে কর্তৃপক্ষ। কারণ নতুন কর্মী নিয়োগ করলে কম বেতন দেওয়া যায়। এ কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ২০২২ সালের ১১ জুন প্রায় ৫০ জন টোল কালেক্টর যোগদান করলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র আটজন। দুই বছরে টোল ম্যানেজার পরিবর্তন হয়েছে অন্তত সাতজন। অনেক অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফও পরিবর্তন হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা বহুমুখী সেতুর টোল কালেক্টর ফজলুল হক বলেন, ‘সব টোল কালেক্টর মিলে বেতন বৃদ্ধির জন্য একটি আবেদন করেছি। এখনো এর কোনো অগ্রগতি জানি না। তবে এটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে আমাদের বেতন অনেক বেশি। কিন্তু সে অনুযায়ী আমরা বেতন পাই না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে এত কম বেতনে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
একইভাবে সাগর হোসাইন, মিটু সিকদার, নাহিদা আক্তার, বাদল হোসাইন, আফরোজা আক্তার, চন্দন চৌধুরী, ফাতেমা আক্তারসহ বেশির ভাগ টোল কালেক্টর জানান, তাঁদের যে বেতন দেওয়া হয় সেটা সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বেতনের ৩৫ শতাংশেরও কম। আর পদ্মা বহুমুখী সেতুর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ তাসমিন বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো এখনো ভালো জানি না।’
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বেতনের টাকা লুটপাটের বিষয়ে একাধিক অভিযোগ জমা হয় সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে। এরপর সেতু কর্তৃপক্ষের চাপে কর্মীদের বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হলেও টাকা বাড়ানো হয়নি। ফলে সেতু কর্তৃপক্ষ টেলিটেল কমিউনিকেশনস লিমিটেডকে তাদের নিয়োজিত কর্মীদের বেতন স্টেটমেন্ট দাখিলের জন্য কয়েকবার নির্দেশ দেয়। কিন্তু টেলিটেল কমিউনিকেশনস কর্মীদের বেতন স্টেটমেন্ট প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে।
পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের কাজ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) এবং চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড (এমবিইসি)। পাঁচ বছরের জন্য তাদের ৬৯৩ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা সেতু বিভাগের হয়ে টোল আদায়, সেতুর দুই প্রান্তে ওজন মাপার যন্ত্র বসানো, সেতুতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও আনুষঙ্গিক মেরামতের দায়িত্বে রয়েছে। এ জন্য সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করছে টেলিটেল কমিউনিকেশনস লিমিটেড। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয় টেলিটেল। কারণ টেন্ডারের মাধ্যমে তারা এই কাজ পায়নি। ২০২২ সালের ২৫ জুন বহুল কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হয়।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বলেন, ‘টেলিটেল টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পায়নি। কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশনের (কেইসি) প্রস্তাবে সাবকন্ট্রাক্টর হিসেবে উল্লেখ ছিল। সে অনুযায়ী তারা কাজ করছে। এখন সব কিছু দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে টেলিটেল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরিদউদ্দিন খানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর টেলিটেল অফিসে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তিনি অফিসে আসেননি।
কর্মীদের বেতন কম দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে টেলিটেল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের মুখপাত্র ও এইচআর বিভাগের প্রধান রায়হানুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে বর্তমানে আমাদের ১৩০ জন কর্মী কাজ করছেন। তাঁরা তাঁদের নির্ধারিত বেতন পাচ্ছেন কি না এ জন্য আবেদন করুন। তবে এ বিষয়ে তথ্য দেওয়া নিষেধ। আর কর্মীদের কত টাকা বেতন দেওয়া হচ্ছে, এটা কনফিডেনশিয়াল বিষয়।’
গত ১৪ আগস্ট মাওয়া ও জাজিরা টোল প্লাজায় কর্মরত ৪৪ জন টোল কালেক্টর বেতন বৃদ্ধির জন্য টেলিটেল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনে বলা হয়েছে—গত ১১ আগস্ট কিছুসংখ্যক টোল কালেক্টরের বেতন দুই হাজার টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বিবেচনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং আমাদের বেতন বৃদ্ধি করে ৩০ হাজার টাকা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।