মানসিক স্বাস্থ্য বর্তমান বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনের যাপিত জীবনে আমাদের অনেকেই হয়তো নানা কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যার ছাপ পড়ছে কর্মক্ষেত্রেও। এ অস্থিরতা কিছুতেই কাটছে না। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেওয়ার অভ্যস্ততা তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। অথচ সময়মতো সঠিক কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা পেলে এ ধরনের রোগী সহজেই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন।
উন্নত বিশ্বে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী শুধু বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এতে বছরে গড়ে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়।- অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
দেশে কতজন মানুষ মানসিক রোগে ভুগছেন এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গত পাঁচ বছরে কোনো জরিপ বা গবেষণা করা হয়নি। ২০২২ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল ঠিক করা হলেও এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ চাকরি হারান।
সরকারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ বা সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন ৩৫০ জন। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন ০ দশমিক ১৭ জন। অন্যদিকে, দেশে মোট মনোবিদ বা সাইকোলজিস্ট আছেন ৫৬৫ জন বা প্রতি লাখে ০ দশমিক ৩৪ জন। সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার আছেন সাতজন বা প্রতি লাখে ০ দশমিক ০০৪ জন। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ৩২৪ জন বা প্রতি লাখে ০ দশমিক ১৮ জন। নার্স রয়েছেন ৭০০ জন।
মানসিক রোগের চিকিৎসায় দেশের এমন হালচালের মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পৃথক সভা, সেমিনার ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য, অগ্রাধিকার দেওয়ার সময় এখনই’।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক। তাদের বেশিরভাগই কর্মক্ষম। পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল হওয়া সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে এর স্বীকৃতি না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও হতাশায় তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত।
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) হাসপাতালটির বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ভর্তি রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রোগীদের বেশিরভাগই বিষণ্নতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যা নিয়ে এসেছেন। এছাড়াও অনেকে সোমাটিক সিম্পটম ডিজ-অর্ডার (মানসিক রোগের সমষ্টি), অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ-অর্ডার (অবাঞ্ছিত চিন্তাভাবনা), বাইপোলার ডিজ-অর্ডার (অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রবণতা), সিজোফ্রেনিয়ো (উদ্ভট চিন্তা, অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা) ও অন্যান্য সাইকোটিক ডিজ-অর্ডার নিয়ে এসেছেন।
মানসিক রোগীদের মধ্যে ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু-কিশোর চিকিৎসার আওতায় আসছেন না। চিকিৎসা শুরু হতেই গড় বিলম্ব হয় ২৪ থেকে ৩৬ মাস।- ডা. নাহিদ আফসানা জামান
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এ বছরের চলতি অক্টোবর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৪ হাজার ৭৪৪ জন। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ৬৫৮ জন শিশু-কিশোর। শতাংশের হিসেবে এ হার ১০ শতাংশ। এদের বেশিরভাগেরই কনডাক্ট ডিজ-অর্ডার বা আচরণগত সমস্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম পারিশ্রমিক, কর্মী ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়ে মূলত কর্মীরা বিষণ্নতায় ভোগেন। কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ কাজ হারান। এসব মানুষ অনুপস্থিতি, কর্মদক্ষতা হ্রাস, কাজে কম মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং মনে রাখার সমস্যায় ভোগেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নত বিশ্বে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী শুধু বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এতে বছরে গড়ে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়। এসব রোগীদের ৫০ শতাংশ চিকিৎসাসেবা নেন না। অনেক সময় মানসিক সমস্যার কথা মুখ ফুটে বললে চাকরি হারানোর ভয় থাকে।
‘তবে কাজের চাপ, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, উদ্বেগ, পরিবারে সময় কম দেওয়া ইত্যাদি কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর মানসিক চাপ বাড়ে, যা কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়’- বলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের ফেজ বি রেসিডেন্ট ডা. নাহিদ আফসানা জামান বলেন, মানসিক রোগীদের মধ্যে ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু-কিশোর চিকিৎসার আওতায় আসছেন না। চিকিৎসা শুরু হতেই গড় বিলম্ব হয় ২৪ থেকে ৩৬ মাস। বিলম্বজনিত কারণে মানসিক রোগ চরমমাত্রা ধারণ করতে পারে এবং এক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হন রোগীরা।