আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই ‘রাষ্ট্র’ সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য প্রথমে ছয়টি ও পরে চারটি কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। পরে আরও যে চারটি কমিশনের প্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাদের গেজেট এখনো প্রকাশ হয়নি। গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর তাদের কাজ শুরু হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কারের কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে নতুন সরকারের জন্য। রাষ্ট্রযন্ত্রকে মানবিক, গণতান্ত্রিক করতে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যত কর্মচারী যুক্ত আছেন- জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয়, তাদের জনগণের কল্যাণের জন্য প্রস্তুত করা এবং পুরো ব্যবস্থাটাকে সংস্কার করার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজটা সরকারকে করতে হবে। তারা বলছেন, অতীতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এটি করেনি, ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক সরকার তা করবে না, তাই এ সরকারকেই সেসব সংস্কার করতে হবে। পুরনো অচলায়তন ভেঙে বদলাতে হবে সবকিছু। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠনের প্রধানের নাম ঘোষণা করেন। এরপর শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রেখে ৩ অক্টোবর পাঁচটি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশ করা হয়। সেগুলো হলো, বিচার বিভাগ, পুলিশ, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ও দুর্নীতি দমন কমিশন। ৭ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশনের। প্রথমে এই কমিশনের প্রধান করা হয়েছিল আইনজীবী ড. শাহদীন মালিককে। পরে তাঁর পরিবর্তে কমিশন প্রধান করা হয় অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজকে। ১৭ অক্টোবর আরও চারটি কমিশন করার কথা ও প্রধানদের নাম জানান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সেগুলো হলো- স্বাস্থ্য কমিশন, গণমাধ্যম কমিশন, শ্রমিক অধিকার কমিশন এবং নারীবিষয়ক কমিশন। জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংবিধান সরাসরি যুক্ত। সংবিধানের বাইরে সেগুলো সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। কাজেই আগে সংবিধান সংশোধনে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। সংবিধানের আলোকে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে বাংলাদেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে গত এক দশকে। তাই আগামীতে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে সবার আগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কিংবা এ বিষয়ে সংবিধান সংশোধন কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয় সেদিকে তাকিয়ে থাকবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধানের বিষয়টি থাকবে মৌলিক। সংবিধান সংস্কার করা হলে তার ওপর ভিত্তি করেই অন্য কাজগুলো করতে হবে। সংস্কার কমিটিতে থাকা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভিতরে দীর্ঘদিনের অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার তথ্য সামনে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অচলায়তন চলে আসছিল। এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত দিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এমন অনেক দিকই রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে। এগুলো সংস্কার করা হবে। বদলে যাবে সবকিছু। আসবে মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটাদাগে সুশাসন ও সুশৃঙ্খলব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটা বড় আকাক্সক্ষা তৈরি করা হয়েছে। কমিশনের সদস্যরা সেভাবেই কাজ করছেন।
সংস্কার কমিশনের মধ্যে দেশের মানুষের নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের দিকে দৃষ্টি বেশি। এখানে সংস্কারের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তারা পুরোদমে কাজ শুরু করছেন। নিজেদের মধ্যে বৈঠক, আইনবিধি পর্যালোচনা করছেন। নির্বাচন কমিশনে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে কমিশন নিয়োগ আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণবিধি। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার গত মঙ্গলবার বলেন, ‘এখন সবকিছুই পর্যালোচনা চলছে। সিদ্ধান্ত হবে শেষের দিকে। আমরাও সংলাপ করব। ইসি সংস্কার কমিশনের কাজ অনেক। কতগুলো আইন; কতগুলো বিধিবিধান সবকিছুই পর্যালোচনা করতে হবে; তারপর সিদ্ধান্ত।’ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আরেকজন সদস্য জানিয়েছেন, আমরা তো ফুলটাইম কাজ করছি। প্রতিদিনই আমাদের বৈঠক হচ্ছে। আমরা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করছি। প্রচলিত আইনবিধি দেখছি। আমাদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। আমরা নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক করছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা প্রাথমিক সুপারিশ তৈরি করে তারপর আরও কাজ করব। তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের সুপারিশ পেশ করব। পুলিশ সংস্কার নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার কর্মকান্ড জনগণের বিপক্ষে পুরো বাহিনীকে দাঁড় করিয়েছে। ফলে মানুষের আস্থা কমেছে এ বাহিনীর প্রতি। যদিও বর্তমানে পুলিশ সদস্যরা জনবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই পুলিশ সংস্কারে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয় অথবা কী কী বদলে যাচ্ছে তা দেখতে চোখ রয়েছে দেশবাসীর। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী তৈরি করার জন্য ভালো একটি সুপারিশ করতে পারব। কমিশনে যারা আছেন, তারা সবাই অভিজ্ঞ। তারা পুলিশ নিয়ে অতীতে অনেক কাজ করেছেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিচ্ছেন। আমরা এরই মধ্যে অনেক বৈঠক করেছি। আমরা বাইরে থেকেও যারা বিশেষজ্ঞ, তাদের মতামত নিচ্ছি। মতবিনিময় করব। সাধারণ মানুষের মতামতও নেব। এটা একটা বিশাল কাজ। চেষ্টা করছি নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে। সেজন্য একটা প্রাথমিক ড্রাফট করে তার ওপর আবার আমরা আলোচনা করব, তথ্য নেব, মতামত নেব, তারপর চূড়ান্ত করব। আমাদের টার্গেট হলো পুলিশকে জনগণের পুলিশ করার মতো একটা সুপারিশ করা।’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও রাজনৈতিক সরকারের আমলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না-এমন ধারণা জনমনে। দুদক রাজনৈতিক প্রভাব এবং আমলাতন্ত্রের কাছে জিম্মি। এর থেকে সংস্থাটিকে মুক্ত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। দুদকের উচ্চ পর্যায়ে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে যারা ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত। পাশাপাশি দুদকের আলাদা প্রসিকিউশন টিম থাকা প্রয়োজন। পরবর্তী যে কোনো সরকারের অধীনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সংস্কার কমিশন সেই দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে বলে মনে করে নাগরিক সমাজ।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদকের আইনকানুন পরিবর্তন যতটুকু করা প্রয়োজন সেটা নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা, দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে যা যা প্রয়োজন সেই সুপারিশ আমরা করব। আমাদের বৈঠক চলমান আছে। কাজ চলছে, যথাসময়ে জানানো হবে।’
বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়েও দেশবাসীর আগ্রহ রয়েছে। বিচার বিভাগকে আরও বেশি স্বাধীন করতে কী কী সংস্কার করা প্রয়োজন তা নিয়ে কাজ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও এরই মধ্যে বেশ কয়েটি বৈঠক করেছে বলে জানা গেছে। কমিশন সদস্য, সাবেক বিচারক ও আইনজীবী মাসদার হোসেন বলেন, আমরা প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছি। এখন এজেন্ডাগুলো নির্ধারণ করছি। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি।’জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক কে এম ফিরোজ আহমেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমরা এখন পর্যন্ত একটি বৈঠক করেছি। ফলে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আরও কয়েকটি বৈঠক করলে বুঝতে পারব আমরা কোন জায়গায় আছি, কোন দিকে যাব।