ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, হাসপাতালে সিন্ডিকেট এবং টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। নিজ জেলায় একক আধিপত্য গড়ে তোলাসহ ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার করেছেন তিনি। বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতি করে স্ত্রীসহ স্বজনদের নামে-বেনামে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁর দুর্নীতি ও অপকর্মের তথ্য প্রকাশ করতে চাইলে সাংবাদিকদের দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হতো।
আর এসবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে মিথ্যা অভিযোগে দেওয়া হতো মামলা। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্মসূচিতে শিক্ষর্থীদের ওপর হামলা এবং ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা এক মামলায় গত ১৬ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে আদালত কারাগারে পাঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক এই সংসদ সদস্য ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর কোনো সন্তান নেই। মন্ত্রী থাকার সময় তিনি নিজ বড় ভাইয়ের ছেলে পার্থ সারথী সেনকে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) হিসেবে নিয়োগ দেন। মন্ত্রী থাকাকালীন প্রভাব খাটিয়ে পার্থকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেন। এ ছাড়া নিজ জেলার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগে লাখ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাঁর হলফনামার তথ্য অনুযায়ী নিজের সম্পদ তেমন না বাড়লেও তাঁর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে অনেক। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তাঁর নগদ টাকা ছিল ৩২ লাখ, কিন্তু ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তাঁর নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ১০ লাখ এক হাজার ৪৯৭ টাকা।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের হলফনামায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক দালানের কলামটি ফাঁকা থাকলেও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের কলামে ঠাকুরগাঁও ও ঢাকায় একটি করে বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট দেখানো হয়েছিল। ২০১৮ সালের হলফনামায় তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা মূল্যের একটি আবাসিক বাড়ি এবং ৬১ লাখ সাত হাজার ১৪৩ টাকার মূল্যের ঢাকার উত্তরায় পাঁচটি ফ্ল্যাট দেখানো হয়।
আর ২০২৪ সালে নিজের নামে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়ায় তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা মূল্যের বাড়ি, ঢাকার উত্তরায় ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯০ টাকা মূল্যের ৮ শতাংশ জমির ওপর দোতলা বাণিজ্যিক ভবন দেখানো হয়েছে, যার নির্মাণ খরচ দেখানো হয়েছে মাত্র ৬০ লাখ টাকা।
হলফনামায় তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। বাস্তবে নামে-বেনামে রমেশ চন্দ্র সেনের রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রমেশ চন্দ্র সেন জেলার বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল ও কলেজের সভাপতি ছিলেন। তাঁর নিজ এলাকায় যেকোনো স্কুল ও কলেজে শিক্ষকসহ অন্যান্য নিয়োগে অনেকের কাছ থেকে লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ দিতেন। অনেকে টাকা দিয়েও চাকরি পাননি। নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালে তিনি নিজেই উপস্থিত থেকে টাকা লেনদেন করতেন।
কিছুদিন আগে সদর উপজেলার পাহাড় ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও নৈশ প্রহরী নিয়োগে চাকরি পাইয়ে দিতে রমেশ সেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী নজরুল ইসলাম স্বপনের মাধ্যমে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এসব অনিয়মের খবর মিডিয়ায় প্রকাশ করায় মামলা করেন রমেশ সেন, যা এখনো চলমান।
কামরুল হাসান নামেন এক ব্যক্তি জানান, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। হাসপাতালের যাবতীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাবার সরবরাহ, সরকারি ও স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়োগসহ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাঙালিপাড়ার বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, হাসপাতালের উন্নয়নের নামে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন রমেশ চন্দ্র সেন। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে এমপির ভাগ্নে নিপুন মোহন্ত তাঁর কাছ থেকে তিন লাখ ১০ হাজার টাকা নেন। নিজের গরু-ছাগল বিক্রি করে এবং স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এই টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আজ পর্যন্ত চাকরি পাননি।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া রামনাথ সেনপাড়া গ্রামের ধান ব্যবসায়ী রমেশ চন্দ্র সেন ১৯৯০ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এরপর তিনি ১৯৯৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
উপনির্বাচনটি হয়েছিল ওই আসনের সংসদ সদস্য খাদেমুল ইসলাম ১৯৯৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করায়। এরপর তিনি ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে টানা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংসদ সদস্য পদ হারান রমেশ চন্দ্র সেন। বর্তমানে এই সংসদ সদস্য কারাগারে রয়েছেন।