রবিবার দুপুর ২টা। রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ পার হতেই রাইদা পরিবহন নামের একটি বাস থামান ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল। তিনি হাত বাড়িয়ে দেন চালকের দিকে। এ সময় যাত্রীরা বিষয়টির দিকে খেয়াল করতে থাকেন।
চালক ইতস্তত করছিলেন। কারণ এর আগে এমনভাবে হাত বাড়ানোর মানে ছিল টাকা নেওয়া। পুলিশ সদস্যরা মানুষের সামনেই টাকা নিতেন। কনস্টেবল চালককে বললেন ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ গাড়ির কাগজপত্র দেখাতে।
গাড়ির পেছনেই ছিলেন সার্জেন্ট। কনস্টেবল জানালেন, সার্জেন্ট কাগজপত্র দেখবেন। চালক কাগজপত্র বের করে কন্ডাক্টরকে দিয়ে কনস্টেবলের সঙ্গে পাঠান। কিছুক্ষণ পরই কন্ডাক্টর দৌড়ে এসে বলে, ‘ওস্তাদ মামলা দিতাছে।
টেহা সাদছিলাম, নেয় না।’ এক যাত্রী জিজ্ঞেস করেন, ‘কিসের মামলা দিচ্ছে?’ তরুণ কন্ডাক্টর বলেন, ‘ওস্তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই।’ এ সময় যাত্রীদের মধ্যে দুজন চালককে মারতেও চান। চালক বলতে থাকেন, ‘এইভাবে তো চার-পাঁচ বছর ধইরা চালাইতাছি, সমস্যা তো হয় নাই।’ তাঁর কথা শুনে যাত্রীরা আরো ক্ষিপ্ত হন।
শুধু এ ঘটনাই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রাফিক পুলিশ প্রতিদিনই সড়কে শৃঙ্খলা আনতে মাসখানেক ধরে বেশ সক্রিয়। প্রতিদিনই বিভিন্ন অপরাধে পরিবহনের চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে তারা। রাজধানীতে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার বেশি জরিমানার টাকাই উঠছে। গত অক্টোবর মাসে ট্রাফিক বিভাগ ১৪ কোটি ২৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গত রবিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে এক হাজার ৬৮২টি। ২১৫টি গাড়ি ডাম্কিং এবং ৪৭টি গাড়ি রেকার করেছে ট্রাফিক বিভাগ। গত ২৬ অক্টোবর এক দিনেই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে দুই হাজার ৯৫৭টি মামলা করা হয়। জরিমানা আদায় করা হয় এক কোটি ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
ট্রাফিক বিভাগের মতো রাজধানীতে যৌথ বাহিনীও বিশৃঙ্খলা রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। গত ১ নভেম্বর রাতে খিলক্ষেত থানাধীন ৩০০ ফিট মহাসড়কে উত্তরা আর্মি ক্যাম্ক, ট্রাফিক পুলিশ ও খিলক্ষেত থানার পুলিশ মিলে অভিযান শুরু করে। এতে চারটি গাড়ি জব্দ করা হয়। মামলা করা হয় ১১৯টি। আর জরিমানা আদায় করা হয় দুই লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা। পরদিন আবারও খিলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ স্বতন্ত্র এডিএ ব্রিগেড, ট্রাফিক পুলিশ ও খিলক্ষেত থানার পুলিশ অভিযান চালায়। তাদের এই অভিযানের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর যানবাহনচালকদের মাঝে সতর্কতা দেখা যাচ্ছে।
জানা গেছে, ট্রাফিক পুলিশ এবার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। যেসব বাস রেস করছে সেগুলো চিহ্নিত করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক মামলার কারণে তাদের জরিমানাও গুনতে হচ্ছে অনেক। এ কৌশল নেওয়ার পর ঢাকায় বাসের রেস অনেকটা কমেছে বলে এক ট্রাফিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দুই দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ঘুরে বাসের রেস আগের চেয়ে কমতে দেখা গেছে। ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের চালক আলীমুজ্জামান গতকাল বলেন, ‘যেভাবে মামলা দিতাছে, অহন আর ড্রাইবাররা আগের মতো রেস করে না। এরপর আবার সেনাবাহিনী কোন সময় ধইরা বসে, সেই ভয়ে আছে সবাই।’
গত শনিবার আইএসপিআর থেকে জানানো হয়, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ট্রাফিক আইনের পরিপন্থী সব ধরনের অবৈধ কার্যক্রম দমনসহ আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর এ ধরনের কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান বলেন, ‘বাসের রেস বন্ধ করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করাসহ সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে যানজট নিরসন করা কষ্টকর। এখানে গাড়িচালকদের যেমন দায় আছে, তেমনি বিভিন্ন এলাকার রাস্তাও ভাঙা। অনেক রাস্তায় বড় বড় গর্ত। জনবহুল এই ঢাকা শহরে একটি পয়েন্টে গাড়ি আটকে গেলে কয়েকটি পয়েন্টে প্রভাব পড়ে। এ কারণে আমরা রাস্তা ঠিক করার জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি।’ তিনি বলেন, রাস্তাগুলো মেরামত করা হলে যানজট কিছুটা কমবে।
সূত্র জানায়, পরিবহনের বিশৃঙ্খলা রোধে মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা বলেন, ‘রাস্তা ঠিক করার আবেদন আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে অনেক ঠিকাদার পলাতক। আবার নতুন করে রাস্তার ঠিকাদার নিয়োগ করাও সময়ের ব্যাপার। এ ছাড়া ওয়াসাও অনেক সময় রাস্তা কাটে, যেটা এক মাসে ঠিক করা যায় সেটা ছয় মাস লেগে যায়। এসবের জন্যও সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করা হয়। রাস্তা ঠিক করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কাজ করছেন।’