গণপরিবহনের সংকটে প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঢাকার ১১০টি রুটের জন্য বাস-মিনিবাসের অনুমোদিত সীমা ৭ হাজার ৪৩। প্রয়োজন ও রুটের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সরকারি একটি কমিটি এই সীমা প্রস্তাব করেছে। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ঢাকা মহানগরীতে মোট ৮৯৩টি বাস-মিনিবাস নিবন্ধিত হয়েছে। ২০২৩ সালে ১ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০২২ সালে নিবন্ধিত হয়েছে ২ হাজার ২৩৩টি বাস-মিনিবাস।
ছোট ছোট গাড়ি অধিক হারে রাস্তায় নামার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা। এসব যানবাহনের কারণে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকায় মানুষের কর্মক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের কর্মস্পৃহা লোপ পাচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা।
যানজটের কারণে সড়কে বড় গাড়ি অনেকটাই কমে গেছে। এ বিষয়ে এক পরিবহন মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, চালকরা এখন আর আগের মতো নির্দিষ্ট অর্থের চুক্তিতে গাড়ি নিতে চাচ্ছে না। তারা বলছেন, যা আয় হবে তার আধাআধি তাদের দিতে হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছে, রাস্তায় যে পরিমাণ যানজট থাকে তাতে সারা দিনে দুইটি ট্রিপ দেওয়াও কঠিন হয়ে যায়। সাভার থেকে সদরঘাটগামী সাভার পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘সকালে গাড়ি নিয়ে সাভার থেকে বের হলে কখন যে সদরঘাট পৌঁছাতে পারব তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। যানজটের কারণে অনেক সময় আমরা সদরঘাট না গিয়ে বাধ্য হই গুলিস্তান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে। কিন্তু গুলিস্তান থেকে গাড়ি ঘুরাতে গেলেও আরেক সমস্যা। ট্রাফিক পুলিশ নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া ইউ টার্ন করতে দেয় না। আবার ট্রাফিক আইন মেনে ঘুরে আসতে গেলে সেই যানজটের মধ্যে পড়তে হয়। তাই আমরা কন্ট্রাক্টে (চুক্তিতে) গাড়ি নিতে উৎসাহ পাচ্ছি না।’
বাস মিনিবাসের সংকট :বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব রুটে বর্তমানে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার যানবাহন চলাচল করছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। রাস্তায় গণপরিবহন কম থাকায় অনেক যাত্রী প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও রিকশার মতো ছোট যানবাহনের দিকে ঝুঁকছেন, যা রাজধানীর তীব্র যানজটকে তীব্রতর করে তুলছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. টুটুল বলেন, তার ফার্মগেটের অফিস থেকে পুরান ঢাকার বাসায় যাতায়াতে গণপরিবহন ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি গুরুতর সমস্যায় পড়ছেন। এক বছর আগেও রাত ৯টার দিকে ফার্মগেটে প্রতি ১০ মিনিট পরপর (৩ নম্বর রুটের) বাস ছিল। এখন তাকে বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
কী বলছে বিআরটিএ :বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, শহর ও সংলগ্ন এলাকায় ৩৮৬টি অনুমোদিত রুট থাকলেও এর মধ্যে কেবল ১১০টি এখন চালু রয়েছে। কারণ কর্তৃপক্ষ প্রায় এক দশক আগেই এই রুটগুলোর মধ্যে বেশ কিছু রুট এক করে দিয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন সরকারি সংস্থা ঢাকা মেট্রো প্যাসেঞ্জার অ্যান্ড গুডস ট্রান্সপোর্ট কমিটির কাছ থেকে ৫ হাজার ৫৯৪টি বাস রুট পারমিট পেয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক কর্মকর্তা জানান, ধারণক্ষমতা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ১১০টি রুটে ৭ হাজার ৪৩টি বাস-মিনিবাসকে রুট পারমিট দেওয়ার সুপারিশ করেছে সরকারি কমিটি। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি নতুন বাসকে রুট পারমিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রুটগুলোকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০ বছরের আয়ুষ্কাল অতিক্রম করে ফেলায় ১ হাজার ১৫০টি বাস-মিনিবাসের রুট পারমিট ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। বিআরটিএর এই কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ৪ হাজার ৪৪৪টি বাস চলাচলের অনুমতি রয়েছে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ থাকা শহরে বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিন্ডিকেটের প্রভাব :নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন নেতা বলেন, পরিবহন মালিকদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটকে মোটা অঙ্কের টাকা না দিয়ে কেউ রুট পারমিট পায় না। এর ফলে উদ্যোক্তারা বাস পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, নগরীর অধিকাংশ বাস মালিক দৈনিক চুক্তিতে চালকদের গাড়ি ভাড়া দেন। ট্রিপ-ভিত্তিক পরিষেবা নামে পরিচিত এই সিস্টেমে চালকরা প্রতিদিনের ট্রিপের ভিত্তিতে মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকেন। যত বেশি ট্রিপ দিতে পারবে, তত বেশি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে চালকরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, যা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। এই ব্যবস্থার ফলেই রাজধানীর বাস পরিষেবার মান উন্নত হয়নি বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বিগত সরকারের আমলে বাস সার্ভিসের পরিবর্তে মেট্রোরেলের মতো ভারী বিনিয়োগ প্রকল্প অগ্রাধিকার পেয়েছে। মেট্রোরেলের একটি লাইন চালু হয়েছে এবং আরও দুটি নির্মাণাধীন। যদি বাসের রুটগুলো যথাযথভাবে সক্রিয় করা যায়, তাহলে মেট্রোরেলের তিনটি লাইনে যে পরিমাণ যাত্রী যাতায়াত করবে, তার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি যাতায়াত করবে বাসেই।