মিরপুরের প্রতিটি অবৈধ কাজের পেছনেই গডফাদার হিসেবে কাজ করতেন ‘যুবরাজ’ খ্যাত মাইনুল হোসেন খান নিখিল। মাদক ব্যবসা, জমি বা বাড়ি দখল, বস্তি নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য, বিআরটিএর দালাল সিন্ডিকেট—এসব অপকর্মের একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন তিনি। প্রতিটি খাত থেকেই মাসে ন্যূনতম আয় ছিল কোটি টাকার ওপরে। তবে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-১৪ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্যের অন্যতম আয়ের উৎস ছিল দেশজুড়ে যুবলীগের জেলা কমিটির পদ বাণিজ্য।
দলের নিষ্ঠাবান কর্মীদের ঠকিয়ে অর্থের বিনিময়ে কমিটির বিভিন্ন পদ বিক্রি করতেন তিনি। পদভেদে নিতেন তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা। দুই কোটি টাকার বিনিময়ে নোয়াখালীতে যুবলীগের একটি জেলা কমিটিতে সভাপতির পদ পেয়েছেন আলী আকবর (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, ‘নেতাকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি টাকা দিলেই পদ দেন তিন।
নিখিল জানান, ‘অন্য কেউ হলে এই পদের জন্য অন্তত চার কোটি টাকা চাইতাম। যেহেতু কাছের লোক, দুই কোটি টাকা দিলেই হবে।’
আলী আকবর আরো বলেন, নিখিল নিজেও একজন হাইব্রিড নেতা।
তিনি প্রথম স্বেচ্ছাসেবক লীগের ওয়ার্ডভিত্তিক রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরে সাংসদ নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসার পর অনেক প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাও তাঁর কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। শুধু পদ বাণিজ্য করেই তিনি হাজার কোটি টাকা আয় করেন।
জানা যায়, ঝুট ব্যবসার আড়ালে মিরপুরের অধিকাংশ গার্মেন্টস থেকে চাঁদা তুলতেন নিখিল।
বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। সবুজ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি মিরপুর-১২ নম্বরে অবস্থিত আজমল ও ইপিলিয়ন গার্মেন্টস থেকে চাঁদা তুলতেন। কালাপানি ২৪ তলা গার্মেন্টস নামের পরিচিত পোশাক কারখানা থেকে চাঁদা তুলতেন জুয়েল রানার মাধ্যমে।
এ ছাড়া মিরপুরের বিভিন্ন ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা দোকান, মার্কেট ও ভ্যান থেকেও চাঁদা তুলতেন তাঁর অনুসারীরা। পল্লবী, কালশী, রূপনগর, মিরপুর-৬, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৩, মিরপুর-১ ও মিরপুর-২সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় এসব অবৈধ দোকান থেকে প্রতি মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকা চাঁদা তুলতেন।
নিখিলের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল বিভিন্ন এলাকায় বস্তি দখল করে ভাড়া বাণিজ্য এবং অবৈধ বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সংযোগ দেওয়া। তাঁর দখল করা বস্তিগুলোর মধ্যে চিড়িয়াখানার দুই একর জমি দখল করে গড়ে ওঠা কয়েক শ বস্তিঘর, রূপনগর আবাসিক এলাকায় মণিপুর স্কুলের পেছনে খাল দখল করে গড়ে ওঠা বস্তি এবং কড়াইল বস্তির খোঁজ পাওয়া যায়। এসব বস্তি থেকে তাঁর প্রতি মাসে আয় ছিল কোটি টাকার বেশি। কারেন্ট দুলালসহ একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এসব বস্তিকে কেন্দ্র করেই নির্বিঘ্নে চালিয়েছেন মাদকের সাম্রাজ্য। বস্তিকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায় আয় ছিল প্রায় হাজার কোটি টাকা। মিরপুর-১২ নম্বরে মাদকের এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করতেন রূপনগর এলাকার ট-ব্লকের রহিমের মাধ্যমে।
মিরপুর-৬ থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত এই এলাকায় জমি দখল ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলাসহ ঝুট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পির মাধ্যমে। তাঁর মাধ্যমে দখল করা হয়েছে মিরপুর-১১তে অবস্থিত এ-ব্লকের একটি বাড়ি, মিরপুর-৭-এর ৫ নম্বর রোডের একটি বাড়ি, ৪ নম্বর রোডের একটি বাড়ি, মিল্ক ভিটা রোড এলাকায় অন্তত তিনটি বাড়ি, যা এখনো বাপ্পির দখলে রয়েছে। জানা গেছে, জমি ও বাড়ি দখলসহ চাঁদাবাজির লাইসেন্সে খুশি হয়ে বাপ্পি নিখিলকে মিরপুর-১ নম্বরের চলন্তিকায় একটি চার হাজার স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। এর বাইরেও দক্ষিণ মণিপুর, মধ্য মণিপুর মোল্লা রোড, পূর্ব মণিপুর বালুর মাঠ ও পশ্চিম সেনপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে সাবেক কাউন্সিলর বাপ্পি বলেন, ‘নিখিলের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অনেক আগেই আমি যুবলীগের পদ ছেড়ে দিয়েছি। তা ছাড়া নিখিল ঢাকা-১৪ আসনের এমপি, আমি থাকি ১৬ আসনে।’
অন্যদিকে সংসদ সদস্য হয়েই শাহ আলী মাজারের দখল নিয়েছিলেন নিখিল। ভাড়া ও চাঁদা মিলিয়ে সেখান থেকেই প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি আয় করতেন তিনি। মাজারের ৩২.১৪ একর জমির মধ্যে বেদখল প্রায় ২৬.৩৮ একর জমি। এসব জায়গায় গড়ে উঠেছে অন্তত চারটি বহুতল মার্কেট, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, কাঁচাবাজার, অফিস ও দোকানপাটসহ হাজারের বেশি স্থাপনা।