পতিত স্বৈরাচারের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এখনো বহাল তবিয়তে। নানা কৌশলে তারা ঢাকাতেই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত। প্রতিনিয়ত হারুনের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করে চলছেন তারা। ইতোমধ্যে বিষয়টি নজরে এসেছে একাধিক সংস্থার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হারুন নিজে আত্মগোপনে থাকলেও তার প্রভাব এখনো বিদ্যমান পুলিশে। রহস্যজনকভাবে এখনো পর্যন্ত তার ঘনিষ্ঠদের কাউকেই আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি। জানা গেছে, হারুনের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন ডিবি মতিঝিলের এডিসি (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি এপিবিএন ঢাকাতেই কর্মরত। শুরুতে রাঙামাটি এপিবিএন-এ বদলি হলেও হারুনের সহায়তায় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতার সহায়তায় কয়েকদিনের ব্যবধানে ঢাকায় পোস্টিং করান। রফিকুল ইসলামকে দিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করানোর বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। জমি দখল, টাকা উদ্ধারে পারদর্শী হওয়ায় হারুনের পছন্দের তালিকায় তার অবস্থান ছিল শুরুর দিকে। জমিজমা এবং টাকা উদ্ধারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার হওয়ার পরও বনশ্রী, রামপুরা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের জমি দখল এবং অন্যায়ভাবে লোকজনকে ধরে এনে টাকা আদায় করতেন।
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের আগ মুহূর্তে বিএনপির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে ধরে এনে নির্মম মারধর করেছিলেন তিনি। ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরের বাসায় গিয়ে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন এই রফিক ও তার ডিসি রাজিব আল মাসুদ। ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ধরে এনে তার রুমেই মারধর চলত। বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ধরে এনে টাকা নেওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশের পরও হারুনের অদৃশ্য শক্তির বলে ডিবিতে থেকে যান তিনি। এ ছাড়া, ডিবি হারুন ও ভোলার সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের প্রভাব খাটিয়ে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিজ স্ত্রীকে সিদ্ধেশ্বরী কলেজে সমাজকর্ম বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করিয়েছেন। হারুনের আরেকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার। ডিবি সাইবার ক্রাইম বিভাগে কর্মরত ছিলেন। হারুনের এপিএস হিসেবেই পরিচিত ছিলেন ডিবি এবং সর্বত্র। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সিরাজের মেয়ের জামাই। জুনায়েদ হারুনের মিডিয়া সেল দেখাশোনা করতেন। হারুন ভাতঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তার বিরুদ্ধেও ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। জুনায়েদ বর্তমানে ঢাকা এপিবিএনে কর্মরত। ডিবির আরেক প্রভাবশালী এডিসি ছিলেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (সাইফ)। খিলগাঁও জোনাল টিমের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন। তিনিও ঢাকায় এপিবিএন-এ কর্মরত। সাইফ পল্টনে থাকা তার ভাইয়ের মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে হারুনের টাকা বিদেশে পাচারে সহায়তা করতেন। প্রথমে সেই অর্থ দুবাই যেত। পরবর্তীতে চলে যেত নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সাইফের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা রয়েছে। ডিবির আরেক প্রভাবশালী সদস্য এবং হারুনের ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম ছিলেন খন্দকার রবিউল আরাফাত (লেনিন)। তার বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা মজনুকে নির্যাতন, যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়নের গর্ভবতী স্ত্রীকে এনে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ডিবিতে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এবং তার ডেমরা টিমের সদস্য কনস্টেবল জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, এই মাদক ব্যবসার টাকা নিয়মিত হারুনের কাছে যেত। হারুনের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় লেলিন ও বর্তমানে র্যাব-৪ এ কর্মরত। যদিও তার বিরুদ্ধে গণহত্যার একাধিক মামলা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ জনগণ কিংবা পুলিশ সদস্য তার বিষয়ে কথা বললে তাদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে অভিযোগ দিতেন পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে। সুন্দরী অভিনেত্রীদের সঙ্গে ডিবি হারুনের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন লেনিন। শুরুতে এ কাজের মাধ্যমেই হারুনের কাছাকাছি যান লেলিন। পর্যায়ক্রমে তাদের ঘনিষ্ঠতার মাত্রা নানা অঙ্গনে ডালপালা মেলে। সম্প্রতি ডিবি অফিসের রিমান্ড নিয়ে মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানির বর্ণনায়ও লেলিনের প্রসঙ্গ উঠে আসে। তদন্ত কমিটির সদস্য না হয়েও লেনিন মাদানির গায়ে হাত তোলেন।
ডিবির আরেক প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন এডিসি আসমা আরা জাহান। ৩০ ব্যাচের এই কর্মকর্তার বাড়ি হারুনের এলাকায়। হারুন সিন্ডিকেটের অন্যতম এই সদস্য এক সময় ডিবি-মাতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আসমার অন্যতম সহযোগী ৩১ ব্যাচের বদরুজ্জামান জিল্লু। কিশোরগঞ্জে সার্কেলে এএসপি হিসেবে কর্মরত থাকার সময়ই আসমার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেড় বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাদা মহিউদ্দিনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া ৩৪ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন হারুন এবং আসমা। বিষয়টি একপর্যায়ে পুলিশের উচ্চপর্যায়েও জানাজানি হয়। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে আসমাকে ডিএমপি সদর দপ্তরের প্রটেকশন বিভাগে বদলি করেন। এখনো তিনি সেখানেই কর্মরত। যদিও হাসিনা সরকারের শেষ দিকে হাসিনা এবং আসমার সম্পর্ক আগের মতোই স্বাভাবিক হয়েছিল বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। ডিবি সাইবার বিভাগের কর্মকর্তা ৩০ ব্যাচের এডিসি মনিরুল ইসলাম। হারুনের পছন্দের কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মনিরুল। ডিবি হারুনের নির্দেশে টাকা পাচারের অন্যতম মাফিয়া এস আলমের লোকজনকে নিয়মিত সহায়তা করতেন। এখনো তিনি ডিবি সাইবারেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, হারুন তার অদৃশ্য শক্তির বলে তার ঘনিষ্ঠদের এখনো পর্যন্ত নিরাপদে রেখেছেন। তারা আইনের মুখোমুখি হলে হারুনের অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে।