কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরিতে অবৈধ চক্রের দৌরাত্ম্য। এ কাজে, ডিএনসিসি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, যেখানেই আপনার বাড়ি হোক- যে কোনো একটি এলাকার নাম দিয়েই মহাখালীর গলি থেকেই বানিয়ে দেবে জন্ম সনদ। ঢাকা উত্তর সিটিতে এর নিয়ন্ত্রণ ডিএনসিসি’র এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা’সহ আরও কয়েকজনের। প্রতি সনদের জন্য তারা নেয় তিন থেকে ৫ হাজার টাকা। যেখানে, সরকার নির্ধারিত ফি মাত্র ১০০ টাকা।
উত্তর সিটি এলাকায় এ চক্রটির আদ্যোপান্ত বের করার জন্য একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে চায় । সন্ধান পাওয়া যায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মচারীর। যার কাছে গেলে, সহজেই মিলবে বার্থ সার্টিফিকেট।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অফিসের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন মাসুদুর রহমান, যিনি নমুনা সংগ্রহের কর্মচারী। মোবাইলে ফোনে তিনি তার অফিসে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে ফোন দেয়ার পর, তিনি তার কার্যালয়ে না নিয়ে ডেকে পাঠালেন পাশের গলিতে। একটি জন্ম সনদের জন্য, পরিচয় গোপন করে সে গলিতে যায় ।
গোপনে নেয়া ভিডিও কথোপকথনে ডিএনসিসি নমুনা সংগ্রহের কর্মচারী মাসুদ কাজীকে বলতে শুনা যায়, জন্মনিবন্ধন সনদ করে দেয়া যাবে, তবে এড্রেস দিতে হবে সাতারকুল এলাকার।
যে কারও কিংবা যে জেলারই হোক, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলেও জন্ম নিবন্ধন করা যাবে এখান থেকেই। প্রতি সনদের জন্য গুণতে হবে তিন হাজার টাকা।
একটি চক্র মিলে কাজটি করে, মহাখালীর ডিএনসিসি’র অঞ্চল-৩ এর অফিসের পেছনের এই গলিতে। আবেদন থেকে সনদপ্রাপ্তি পর্যন্ত সব কাজ হয় এই কম্পিউটারের দোকানগুলোতে। আদতে, যা হওয়ার কথা অনলাইনে বা কার্যালয়ের ভেতরে।
চক্রটির কাজ শুরু হয় এই ডিএনসিসি’র কর্মচারী মাসুদ কাজীকে দিয়ে। মাসুদ প্রথমত কাজটিতে যুক্ত করেন তার ভাগ্নেকে। তিনি নিয়ে যান কম্পিউটার দোকানে। সেখান থেকে আবেদনের প্রক্রিয়া হয়ে গেলে, সিটি কর্পোরেশন অংশের বাকি কাজ করেন চক্রের অন্যতম সদস্য মাসুদ কাজী।
এরপর একটি দোকান থেকে একটি মাত্র আইডি পাসওয়ার্ড দিয়েই হচ্ছে একের পর এক জন্ম নিবন্ধনের সনদ তৈরির প্রক্রিয়া। এ কী করে সম্ভব? এবার পরিচয় প্রকাশ করে সেই গলিতে গেলে, উপস্থিতি টের পেয়ে লাপাত্তা মাসুদ।
ততক্ষণে বেরিয়ে আসে মাসুদের আরও কিছু তথ্য। কর্মচারী হয়েও রাজনৈতিক পরিচয়ই তার শক্তি। মাস খানেক আগে মাসুদকে বদলি করা হয় উত্তরা জোনে। সেখানে থেকেও নিয়ন্ত্রণ করছেন এ চক্র।
এ চক্রের ফাইলগুলোর চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন স্বাস্থ্য সহকারী কর্মকর্তা ও জন্ম নিবন্ধক ডা. ফিরোজ আলম। তার হাতেই থাকে জন্ম নিবন্ধনের রেফারেন্স কপিগুলো সত্যায়িত করার এখতিয়ার। ভারতীয় নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন দেয়ার দায়ে ইতোমধ্যে দুইবার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল এই ডাক্তার ফিরোজের বিরুদ্ধে। সেই নথিও আসে হাতে।
গোপনে নেয়া ভিডিও রেকর্ডিংয়ে ডিএনসিসি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে বলতে শোনা যায়, আমরা আসমান থেকে নাজিল হওয়া কোন প্রতিষ্ঠান নয়। প্রতিনিয়ত আমরা ঘষা–মাজার কাজ করছি।
ডাক্তার ফিরোজের বক্তব্য জানতে চাইলেও নাগাল পাওয়া যায়নি তার। নাকের ডগায় এমন ঘটনা নতুন কিছু নয় সিটি করপোরেশনের জন্য। জানা থাকলেও ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার নেই বলে এড়িয়ে যান ডিএনসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। দায় ঠেলে দেন আঞ্চলিক কর্মকর্তার কাছে।
ডিএনসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি: জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী ফোনে বলেন, এখানে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারাই সবকিছু দেখেন। কিছুই বলতে পারবো না, আমার কোন অথরিটিই নাই।
অভিযোগ খতিয়ে দেখার সেই গতানুগতিক আশ্বাস রেজিস্ট্রার জেনারেলের। তবে, রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসাইনকে প্রশ্ন করা হয়, একটি দোকান থেকে ১টি মাত্র আইডি দিয়ে ১০০টি নিবন্ধন কীভাবে করা যাচ্ছে?
উত্তরে তিনি বলেছেন, এই প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে পারবেন না। ১টি আইডি দিয়ে ১০০টি নিবন্ধন করা কীভাবে সম্ভব! ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন পাঁচ থেকে ছয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং অনেকে সাস্পেনশনে-ও আছে।
পুরো চক্র যখন ক্যামেরায়, তখন বারবার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার আবদার চক্রের গোড়া মাসুদ কাজীর। ফোনে তিনি বলেন, মানুষের উপকার করতে চাই ভাই। সিটি করপোরেশনে আছি। যেকোনো কাজ-কাম থাকলে জানাইয়েন।