ঢাবি প্রতিনিধি: জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনব্যবস্থা আমূল পুনর্গঠন করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন: কার্যকর ও টেকসই সংস্কার’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ অভিমত জানান তারা। জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদ (এনসিপিটি) এ সেমিনারটি আয়োজন করে।
জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদের সভাপতি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম সেমিনারটিতে সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীনের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেমিনারের সূচনা হয়।
অধ্যাপক নাজনীন বলেন, ‘আমরা সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছি। পাকিস্তান আমলে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, প্রত্যেকটার পেছনে ছিল গণতন্ত্রের আকাঙ্খা। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনেও ছিল গণতন্ত্র না পাওয়ার বেদনা এবং গণতন্ত্র পাওয়ার আকাঙ্খা। অবাধে আমরা ভোট দেব, অবাধ নির্বাচন হবে, এটাই আমাদের আকাঙ্খা ছিল। স্বাধীনতার কয়েকবছরের মধ্যেই বাকশাল আমাদের গণতন্ত্রের কবর রচনা করে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয় এবং চারটা পত্রিকা বাদে বাকি সব পত্রিতা নিষিদ্ধ করা হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এসে গণতন্ত্রতে মুক্তি দিলেন। তিনি এসে রাজনৈতিক দল এবং পত্রিকাগুলোকে স্বাধীনতা দিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচারী আওয়ামী আমলে আমি নিজেও ভোট দিতে গিয়ে দেখেছি আমার ভোট হয়ে গেছে। অর্থ্যাৎ, কোনো মানুষ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারেনি। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর আমরা আশাবাদী হতে শুরু করেছি। এখন হয়ত অন্তর্বতীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। আমরা আশা করছি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।’
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম। প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর যথাক্রমে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। মূলত দলীয় সরকারের অধীনে সরকার এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাইলেও এবং নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার পরও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারণ, পুরো নির্বাচনটি পরিচালনা করে সরকারের নির্বাহী বিভাগের লোকেরা-আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ ও সরকারি/বেসরকারি কর্মচারীবৃন্দ। নির্বাচন কমিশন সেখানে লজিস্টিক সাপোর্টস এবং গাইডিং প্রিন্সিপালস সরবরাহ করে মাত্র। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি প্রশাসনের সদস্যবৃন্দই এ সংক্রান্ত নির্বাহী কার্যক্রম সম্পন্ন করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আরও বলে যে, ক্ষমতাসীন সরকার ও দল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে পরাজয় বরণ করতে একদম নারাজ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তারা পরাজয় মেনে নিতে অনিচ্ছুক। নিকট ভবিষ্যতেও এর কোন ব্যত্যয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কাজেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় সরকার নয়, বরং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এর বিকল্প নেই। অতএব, নির্বাচনী সংস্কারের প্রধান ক্ষেত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়াও নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো দূর করতে এবং বাংলাদেশে নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে সংস্কারের বেশ কিছু ক্ষেত্র বিবেচনা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আইনি সংস্কার এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন।’
জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম তার বক্তব্যে বলেন, ‘২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো পাতানো নির্বাচনে মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবে রক্তের নদী বইয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর ফ্যাসিস্ট নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার জন্য তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে এ পরিবর্তন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোটের অধিকারের জন্য এত লোকের আত্মত্যাগ -প্রাণ দিল, আহত হল, নিহত হল, রক্ত দিল, শহীদ হল। জুলাই-আগস্টে কতলোক প্রাণ দিল। অনেক দাবির মধ্যে একটি দাবি ছিল ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েই নতুন নির্বাচন কমিশনকে আগাতে হবে। এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে যে পরিবেশে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট যাকে ইচ্ছে দিতে চান, তাকে যেন দিতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন কমিটমেন্ট দিয়েছেন, আমরা তার ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই।’
অধ্যাপক মাসুম বলেন, ‘অতীতের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এগোতে হবে। তিনি ছাত্র-জনতার পালস বুঝতে পারেন বলে আমি মনে করি। মানুষের বহুল কাঙ্ক্ষিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে অবশ্যই তিনি সফল হবেন সে প্রত্যাশা।’
সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
এসময় আরও বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তারেক ফজল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক স ম আলী রেজা, একই বিভাগের অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মেজবাহ উল-আজম সওদাগর, নিরাপত্তা বিশ্লেষক জিয়া হাসান, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ বি এম মাহবুবুল ইসলাম, সাবেক সচিব শেখ মোতাহার হোসেন, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ শাহ আবদুল হালিম এবং শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।