জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে এসে আবারও প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন কয়েক জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। পাশাপাশি পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদেরও বেশ কয়েক জন প্রকাশ্যে এসেছেন। ইতিমধ্যে মগবাজারে প্রকাশ্যে মহড়া দিয়েছেন সুব্রত বাইন। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মোহাম্মদপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। অনেকের নামেই ফোন করে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অনেকেই চাঁদা দিচ্ছেন।
তবে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে এদের ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না কেউ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গতিবিধিতে নজর রাখছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অন্তত ছয় জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। এদের প্রায় সবাই কমপক্ষে ১৫-২০ বছর ধরে কারাবন্দি ছিলেন। খুন, চাঁদাবাজি, ভাঙচুর ও দখলবাজির অভিযোগে এদের সবার বিরুদ্ধেই ৭ থেকে ১৫টি মামলা ছিল। সব মামলায় জামিন পাওয়ার পর তারা কারাগার থেকে মুক্তি পান। এদের মধ্যে আছেন, পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম। হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ইমন, মিরপুরের আব্বাস উদ্দিন (কিলার আব্বাস নামে পরিচিত), মোহাম্মদুপরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। এদের কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, একজন মানুষ তো সারা জীবন কারাগারে থাকতে পারে না। আদালত যদি জামিন দেয় তাহলে মুক্তিতে সমস্যা কী? জোর করে তো আর তাকে কারাগারে আটকে রাখা যাবে না। তবে হ্যাঁ, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তার দিকে নজরদারি অবহ্যাত রাখতে হবে। তিনি যদি অপরাধ জগত্ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন, তো ভালো কথা। কিন্তু তিনি যদি আবারও অপরাধ জগতে ফিরে যান, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আবারও তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করবে।
২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ঘোষণা করেছিল, তাদের অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তার নামে এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। তাকে ধরিয়ে দিতে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। যদিও কেউ তাকে ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কার নেয়নি।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে দলবল নিয়ে মহড়া দিয়েছেন সুব্রত বাইন। একটি দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। পরে বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীকে ডেকে কথা বলেছেন। এ নিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা সুব্রত বাইনকে প্রথমে চিনতে পারেননি। মুখে দাড়ি রেখেছেন, চেহারায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। তখন এক ব্যক্তি তাকে সুব্রত বাইন বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এই মার্কেট থেকে সুব্রতকে একসময় চাঁদা দিতে হতো। বিশাল সেন্টারের একটি দোকান বন্ধকি সম্পত্তি। মাসুদ নামের এক ব্যক্তি সেখানকার একটি দোকানে তালা ঝুলিয়ে সেটি বিক্রির চেষ্টা করছিলেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়ায় সুব্রত বাইনকে আনা হয়।
পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সাদেক খান আড়তের সামনে ঐ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার দখল নিতে সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের বিরোধ থেকে জোড়া খুনের ওই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর পিচ্চি হেলালকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোহাম্মদপুরের খুনের ঘটনায় পিচ্চি হেলাল গ্রেফতার না হলেও দুই-তিন জন গ্রেফতার হয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার পদ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মাইনুল হাসান বলেছিলেন, আদালতের জামিন নিয়ে যারা কারাগার থেকে বের হয়েছেন তাদের ওপর আমরা নজর রাখছি। আবারও যদি তারা অপরাধকর্মে যুক্ত হন, তাহলে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে। অপরাধ করে কেউ পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী ও কাফরুল এলাকায় সন্ত্রাসীরা বিভিন্নভাবে সক্রিয়। এর মধ্যে মফিজুর রহমান ওরফে মামুন সবেচেয়ে বেশি তত্পর বলে জানা গেছে। মামুন পল্লবীর ‘ধ ব্লকের মামুন’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পল্লবী থানা বিএনপির ৯১ নম্বর ওয়ার্ড (সাংগঠনিক ওয়ার্ড) কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয় তাকে। এছাড়া আব্বাস উদ্দিনের নামেও ফোন করে কেউ কেউ চাঁদা দাবি করছেন। বিদেশে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেন ওরফে সাধুর তৎপরতা এখনো আছে। শাহাদাত ২০০২ সালে মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বর্তমানে ওমরাহ করতে সৌদি আরবে অবস্থান করা আব্বাস উদ্দিন টেলিফোনে বলেন, আমি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুলিশের ডিসি ও ওসিকে বলেছি, আমার নামে যদি কেউ ফোন করে তাকে যেন গ্রেফতার করা হয়। আমি মুক্তির পর ওমরাহ করতে সৌদি আরবে এসেছি। এখনো এখানেই আছি। কারো সঙ্গে টেলিফোনেও কোনো কথা বলি না। অপরাধ জগতের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাই। অনেক মাদকসেবী বা ছিনতাইকারী নিজেদের সুবিধার জন্য আমার নাম বলতে পারে, কিন্তু এদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ তার নাম বললে পুলিশকে জানানোর অনুরোধও তার।
রাজধানীর অপরাধজগত ও সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন, এমন তত্পরতা দেখা যাচ্ছে। পুরোনো সহযোগীদের সংগঠিত করে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহের জন্য এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন তারা। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে পরিস্থিতি বুঝে এখন রাজনৈতিকভাবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণে রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন: রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল ও তার সহযোগীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক নারী। তিনি জানান, তার স্বামী মো. সুমন মিয়াকে সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে নির্যাতন করাচ্ছে। তার স্বামীর মুক্তিসহ পিচ্চি হেলাল ও তার সহযোগীদের হাত থেকে মোহাম্মদপুরবাসীকে বাঁচানোর দাবি জানান জান্নাতুল। গতকাল রবিবার বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তিনি।
জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, মোহাম্মদপুরের একটি জমিকে কেন্দ্র করে পিচ্চি হেলাল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলা করে। আমার স্বামীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। বেশ কয়েক বার আমার বাড়িতে ভাঙচুর ও ডাকাতি করেছে। যার প্রমাণস্বরূপ সিসিটিভি ফুটেজ আমার কাছে আছে। গত সরকারের আমলে বিএনপির কর্মী হওয়ায় বেশকিছু মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার স্বামীকে হয়রানি করা হয়। এখন পিচ্চি হেলালের সহযোগী জাহিদ মোড়ল লালমাটিয়া থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত জমি দখল, ছিনতাই, ফুটপাতে চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে। পিচ্চি হেলালের বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়ারি করতে চাইলে নাম শুনেই পুলিশ জিডি নেয়নি। অজানা কারণে আমাদের অপমান করে বের করে দেয়। এখন আমার দুই বাচ্চাসহ আমার পরিবারের হেফাজতের দায়িত্ব কে নেবে? আমরা কি স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারব না?