গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এসব দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার মুখ্য দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে দুদকে নেই চেয়ারম্যান ও কমিশনার। পদত্যাগের এক মাসের মধ্যে কমিশনার নিয়োগের বিধান থাকলেও এখনও দুদক গঠন করা হয়নি। ফলে থমকে আছে দুর্নীতি রোধের মামলা, চার্জশিট ও অন্যান্য নীতিগত সিদ্ধান্তসহ সব কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা, গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’ এ প্রতিপাদ্যে আজ পালন হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গড়ে তুলতে দুদকের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। কমিশনের কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য নির্মূল করতে হবে। এমন একটি দুর্নীতি দমন কমিশন চাই, যেখানে নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে কোনো প্রকার দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। বিশেষ করে কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দলীয় প্রভাব যেন না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সচিব ও মহাপরিচালকদের আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য নির্মূল করতে হবে।
গত ২৯ অক্টোবর দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং সাবেক কমিশনার জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুন পদত্যাগ করেন। ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ১০ ও ১১ ধারায় চেয়ারম্যানসহ কমিশনারের পদত্যাগ ও তাদের সাময়িক শূন্যতা পূরণে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ১০(১) ধারায় বলা হয়েছে কোনো কমিশনার রাষ্ট্রপতি বরাবর এক মাসের লিখিত নোটিশ প্রেরণপূর্বক পদত্যাগ করতে পারবেন। চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে সাময়িক শূন্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে ১১ ধারায়। ওই ধারা অনুসারে কোনো কমিশনার মৃত্যুবরণ বা স্বীয় পদত্যাগ করলে বা অপসারিত হলে রাষ্ট্রপতি উক্ত পদ শূন্য হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে, এই আইনের বিধান সাপেক্ষে, কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে শূন্যপদে নিয়োগ দান করবেন।
অর্থাৎ আইন অনুসারে পদত্যাগের এক মাসের মধ্যে নতুন কমিশন গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ করতে গত ১০ নভেম্বর সার্চ কমিটি গঠন করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছেÑ সার্চ কমিটি, চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ করতে ‘উপস্থিত সদস্যদের অন্যূন ৩ জনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিশনারের প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে’। সেই কমিটির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়নি। কিন্তু চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগের পর এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে দেড় মাস, গঠন হয়নি নতুন কমিশন।
এদিকে দুদক অকার্যকরের পেছনে প্রধান অভিযোগ, রাজনৈতিক দায়মুক্তি। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা দুর্নীতি করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই বললেই চলে। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্র্নীতিবাজদের আটক, বিচারে দুদকের দৃশ্যমান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়। সেই তুলনায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দুদকের পদক্ষেপ যৎসামান্য। উপরন্তু গত দেড় মাস ধরে কমিশনারবিহীন দুদক। ফলে থমকে আছে কার্যক্রম। কমিশন না থাকায় নতুন করে কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে আপাতত পার পেয়ে যাচ্ছেন দুর্নীতিবাজরা।
এ বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, কমিশন গঠিত না হওয়ায় আইনের ব্যত্যয় অবশ্যই হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে ৩০ দিন। সেটি যদি পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনও ধরা হয়, ইতোমধ্যে সেই সময়কাল পেরিয়ে গেছে। যদিও কেউ কেউ ৩০ কার্যদিবস হিসেবে গণনা করতে চান। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেÑ চেয়ারম্যান-কমিশনাররা না থাকলে দুদকের কোনো কার্যক্রমই চলে না। অনুসন্ধান ও তদন্ত থেকে শুরু করে সব সিদ্ধান্তই কমিশন বৈঠকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সেই অর্থে দুদকের কাজ একরকম বন্ধই বলা চলে। নতুন কোনো কাজ হচ্ছে না। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিয়োগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কমিশন দেরিতে গঠনে দুর্নীতিবাজরা ফায়দা লুটছেন কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, এটা অবশ্যই দুর্নীতিবাজদের বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজ দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে না। তাদের অনেকেরই সম্পদ ক্রোক বা ফ্রিজ হয়নি। অনেকের বিরুদ্ধে এমন তথ্য-উপাত্তও ছিল যে, দীর্ঘদিন অনুসন্ধান ছাড়াই মামলা করা সম্ভব। কিন্তু মামলা হয়নি। পুরো বিষয়টি এক ধরনের কালক্ষেপণের মধ্যে পড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে অপরাধী বা দুর্নীতিবাজরা সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেই। অনেকেই আছেন হত্যা মামলার আসামি, তাদের শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো সম্ভব হয়নি মামলা না থাকার কারণে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে দুদকের বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৪৩৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়। এ সময়কালে ২২৭টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয়। এ বছর ৩২৮টি মামলা ও ৩৪৫টি মামলার চার্জশিট দিয়েছিল দুদক। এ ছাড়া আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে যথাক্রমে ৩১টি, ১০০টি ও ৭৩টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিলেও নভেম্বরে কোনো অনুসন্ধানই শুরু হয়নি। মামলা, চার্জশিট কিংবা অন্যান্য নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে সংস্কারের আগে কমিশন গঠন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত ২৭ নভেম্বর তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, দুদক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনের কার্যক্রম চলমান থাকাবস্থায় সংস্থাটিতে নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটি করা অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাবিরোধী ও একটি অনভিপ্রেত পদক্ষেপ।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কমিশনের কাজ শেষ হওয়ার আগে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস?্য নিয়োগ সম্পন্ন হলে তা এ বিষয়ে সম্ভাব্য সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, সে প্রশ্নও বিশেষভাবে বিবেচ্য। কারণ সংস্কার কমিশনের পরিধির আওতাভুক্ত অন?্য প্রায় প্রতিটি বিষয়ই ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনার জন?্য নতুন কমিশনের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্নীতির মাত্রা কোন দেশে কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। বিদায়ী ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। অর্থাৎ বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে।