দেশের ৩০০ সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প জমা পড়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক সংসদ সদস্য উন্নয়নের অঙ্গীকার পূরণে ২০ কোটি করে টাকা পাওয়ার কথা। এছাড়া প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় ছয়টি করে মাদরাসা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা আরও দুইশ মাদরাসা নির্মাণের টাকা।
পুরো প্রকল্পটিতে খরচ ধরা হয় ৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এসব প্রকল্প আশার আলো দেখার সম্ভাবনা কম বলে জানায় কমিশন।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে একাধিক প্রকল্প আছে যেগুলোতে জনকল্যাণের পরিবর্তে এক গোষ্ঠীর কল্যাণ বেশি হবে। এসব প্রকল্পে নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এসব প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। আমরা সেগুলোর তালিকা তৈরি করছি। যে সব প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা কম সে সব প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে।’
পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও অনেক প্রকল্প প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় ‘শেখ হাসিনা নকশিপল্লি, জামালপুর (প্রথম পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন বলে জানা যায়। হস্তশিল্প, কারুশিল্প, কুটিরশিল্প, তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ৭৭২ কোটি টাকা প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে।
এডিপির মধ্যে ব্যয় কমানোর বড় জায়গা মেগা প্রকল্প। পল্লি উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক খাতে কিছু ছোট প্রকল্প আছে যেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। এসব প্রকল্প বাদ দেওয়াই ভালো হবে।- বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
কমিশন সূত্র জানায়, বর্তমানে জামালপুরের সবগুলো উপজেলায়ই এ শিল্পের কাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৩০০ প্রতিষ্ঠান/উদ্যোক্তা। সবাই নিজের মতো করে কাজ করেন। সবাইকে একত্রিত করার কথা বলে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। অথচ প্রকল্পটি নেওয়ার ফলে তাঁতিদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ সবাইকে একত্রিত করাও সম্ভব নয়। ফলে ৭৭২ কোটি টাকা পুরোটাই গচ্চা যাবে বলে প্রতিবেদন দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন। তারপরও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নেন মির্জা আজম।
দেশের আর্থিক খাত ধুঁকছে দীর্ঘদিন। রয়েছে ডলার সংকট। এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেখা দিয়েছে নতুন সংকটের শঙ্কা। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া চলতি অর্থবছর এবং পরের মিলে সম্ভাব্য ৩৩২৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এগুলোর মধ্যে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে ১২২১টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪১ কোটি টাকা।
মেগা প্রকল্পের বদলে জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকার প্রকল্প চালু রাখা হবে। বড় বা মেগা প্রকল্পের অর্থছাড় বড় হয়। তাই এ বিষয়ে পরে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশের অর্থ অপচয় বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ছাড়া কিছু চলবে না।’
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ দেওয়া মেগা প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাদ্দ ১০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এটিতে রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণ আছে। ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পে বরাদ্দ ১৯৭৫ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। মেট্রোরেল লাইন-১ প্রকল্পে বরাদ্দ ১৯৪২ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ ১৫৮৫ কোটি টাকা। মেট্রোরেল লাইন-৫, নর্দান রুট প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ৯৬৮ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ ১৩০০ কোটি টাকা।
রেলসেতুর জন্য বরাদ্দ ২৫৬০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে জাপানসহ বিভিন্ন সংস্থার ঋণ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৫৪৪ কোটি টাকা, এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে চীন।
দোহাজারী-রামু-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১৪৫৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৭১৭২ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে চীন এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ রয়েছে। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো- মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প। এডিপির বরাদ্দ সব মেগা প্রকল্পে কমানো হবে বলে জানায় কমিশন।
অন্তর্বর্তী সরকারের খরচ কমানোর বড় জায়গা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। এডিপির মধ্যে বড় জায়গা মেগা প্রকল্প। এছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোও পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার কী করবে আমরা জানি না। তবে রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ সরকার আর্থিক সংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি। জুলাই মাসে অর্থনীতি বিকল ছিল, এক মাসে রেভিনিউ কালেকশন কম ছিল। দোকানপাট বন্ধ ছিল। সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি।’
‘এডিপির মধ্যে ব্যয় কমানোর বড় জায়গা মেগা প্রকল্প। পল্লি উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক খাতে কিছু ছোট প্রকল্প আছে যেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। এসব প্রকল্প বাদ দেওয়াই ভালো হবে।’
মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কম? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প নেওয়া যায়, কারণ এসব প্রকল্পের চাহিদা আছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে ফিরে আসার সুযোগ নেই। কারণ এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেক এগিয়েছে। যে সব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো সেগুলো শেষ করা ভালো হবে। তবে যে সব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি বা প্রাথমিক ধাপে আছে সেগুলো বাদ দেওয়া ভালো হবে।’