শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস পূর্ণ হলো আজ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ৮ আগস্ট যাত্রা শুরু করেছিল ড. ইউনূস সরকার। ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বিধ্বস্ত একটি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া এই দুই মাস বয়সী সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের যথার্থ সময় এখনও হয়নি। তবুও, দুই মাসের বিশ্লেষণ বলছে- এসময়ে সরকার বেশি মনোযোগ দিয়েছে সংস্কারে। তবে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে এখনও অস্বস্তি রয়েছে।
প্রথম এক মাসে রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। যাতে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে প্রায় হতাশ হয়ে পড়া জনগণ। সরকারের সংস্কার-উদ্যোগে প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে জনআকাঙ্ক্ষার।
প্রথম মাস পূর্তি উপলক্ষে গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমাদের সরকারের প্রথম মাস কাটলো। দ্বিতীয় মাস থেকে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে নতুন শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের সূচনা করতে চাই। আরও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। প্রথম মাসের কাজ হিসেবে শুধু প্রধান কাজগুলো করেছি। এর সঙ্গে রয়েছে আরও অনেক পরবর্তী কাজ।’
ওই ভাষণে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রথম মাসে আমরা যে গতিতে, যে উদ্যম নিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম, হয়তো সেটা করতে পারিনি বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। আমাদের দ্বিতীয় মাসে যেন আপনাদের মনে দৃঢ় আস্থার সৃষ্টি করতে পারি, সে চেষ্টা করে যাবো।’
‘দ্বিতীয় মাসে যেন আপনাদের মনে দৃঢ় আস্থার সৃষ্টি করতে পারি, সে চেষ্টা করে যাবো’- এক মাস আগে বলা ড. ইউনূসের এই বক্তব্যের মোটা দাগে প্রতিফলন রয়েছে সরকারের সার্বিক কার্যক্রমে। তবে, সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়ায় প্রথম এক মাসে কাঁচা মরিচ, ডিম, সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামে লাগাম এলেও গত কয়েকদিন ধরে তা আবার লাগামহীন। স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ দৈনন্দিন সংসার পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। অবশ্য, নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর-কুমিল্লায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলেও বন্যা; ময়মনসিংহ-শেরপুরে চলমান বন্যা এবং অবিরাম বৃষ্টিও সবজির দাম বৃদ্ধির বড় কারণ। এরসঙ্গে সরকারকে বিপাকে ফেলতে পুরনো সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলেও অনেকের সন্দেহ।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের কষ্টের বিষয়টি সরকারেরও জানা। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারও নড়েচড়ে উঠেছে। নিত্যপয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারক-পর্যালোচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার জেলা পর্যায়ে ‘বিশেষ টাস্কফোর্স’ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি দুই মাসেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার কারণেও জনমনে অসন্তোষ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে, কুপিয়ে মেরে ফেলার মতো কয়েকটি ‘মব জাস্টিসের’ ঘটনা সরকারকেও বিব্রত করেছে। আইন-উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল স্পষ্ট করে বার্তা দিয়েছেন, ‘মব জাস্টিস কোনোমতেই বরদাসত করা হবে না। এব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। যারাই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকুক তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোটের শনিবারের সংলাপেও দলগুলোর পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিন ৮ আগস্ট দেশে ফিরে বিমানবন্দরে ড. ইউনূসও বলেছিলেন, ‘আমার প্রথম কাজ হবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা’। এব্যাপারে গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি’। উল্লেখ্য, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নে ইতোমধ্যে সরকার পুলিশসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন বাহিনীতে নতুন লোকবল নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে।
বন্যার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দায়িত্ব গ্রহণের টানা দুই মাসেই সরকারের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে দাবি আদায়ে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের ঘটনা। বিশেষ করে, বিভিন্ন স্থানে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের বিক্ষোভের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। কারখানায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা সামাল দিতে এখনও ঘাম ঝরাতে হচ্ছে সরকারকে। গতকালও কয়েকটি গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিক-বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ে আন্দোলন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন মোকাবেলা করতেও বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরুর পর থেকেই সংস্কার ও নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল-জোটের সঙ্গে মতপার্থক্যও দেখা দিয়েছে। শনিবারের সংলাপেও এই মতপার্থক্য ছিল দৃশ্যমান। সংলাপে সরকারের কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে বিএনপি, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলেছে- তাদের কাছে এক নম্বর অগ্রাধিকার হচ্ছে সংস্কার।
১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রাথমিকভাবে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। ইতোমধ্যে সবগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনগুলো ইতোমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে। গণমাধ্যম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নেও কমিশন করতে যাচ্ছে সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় মাসে সবচেয়ে আলোচিত ছিল প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফর। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ড. ইউনূস, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এছাড়াও এই সফরে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস ড. ইউনূসের বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে দেশজুড়ে।