কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় নাশকতা ও হামলার ঘটনা ঘটে সদর ও শেরপুর উপজেলায়। এসব ঘটনায় ১৫টি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন কয়েক হাজার। এই আসামি গ্রেফতারের নামেই এখন পুরো জেলায় চলছে পুলিশের অভিযান। বিএনপি-জামায়াতের নামে গ্রেফতার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
অনেক থানাতেই অভিযানের নামে ধরা ছাড়ার বাণিজ্যও চলছে বেশ রমরমা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে প্রতিপক্ষদের তালিকা সংগ্রহ করার অভিযোগও রয়েছে অনেক স্থানে।
এদিকে পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা নাশকতা মামলাগুলোয় রয়েছে নানা ফোঁকফোকর। অপরাধ বিষয়ক একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন এই তথ্য। তাদের মতে, দুর্বল বর্ণনা এবং একই ধরনের ভূলভ্রান্তির কারণে এসব মামলা থেকে প্রকৃত নাশকতাকারীরা সহজেই ছাড় পেয়ে যাবে। অনেক মামলা নিয়ে বাদী হিসেবে আদালতের কাছে আবার জবাবদিহিতার মুখোমুখিও পড়তে হতে পারে পুলিশকে।
গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ
২১ জুলাই রাতে সারিয়াকান্দির কামাপুর ইউনিয়নের দড়িপাড়ায় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে ২৫ থেকে ৩৫ বছরের ৬ জনকে সন্দেহজনকভাবে আটক করেন চন্দানবাইশা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতার পরামর্শে পুলিশ তাদের আটকের পর থানায় নিয়ে যায়। সেখানে পূর্বের নাশকতা মামলায় চালান করার ভয় দেখিয়ে তাদেরকে রাতভর হুমকি ধামকি দেওয়া হয়। ভোরে আটক একজনের আত্মীয়ের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা নেন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দরুল হুদা। এরপর তাদেরকে এই তথ্য বাইরে প্রকাশ না করার শর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে দরুল হুদা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। তবে কাউকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেইনি। এ পর্যন্ত এই থানায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২৩ জুলাই সন্ধ্যায় নন্দীগ্রাম পৌর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ শামছুল হক, পরের দিন ২৪ জুলাই পৌর বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক আলতাফ হোসনেকে গ্রেফতার করা হয় থানার ওসি আজমগীর হোসাইনের নির্দেশে। পরে এই দুই নেতাকে পুরোনো নাশকতা মামলায় চালানের হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে থানা থেকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৮ জুলাই পৌরসভার ১নং ওর্য়াড বিএনপির সভাপতি লোকমান আলীকে রাতের বেলা বাড়ি থেকে নাশকতাকারী হিসেবে আটক করা হয়। এই অভিযানে ছিলেন থানার এএসআই মিন্টু মিয়া ও মামুনুর রশিদ। তবে এই ভাগ্যবান নেতাকে থানা পর্যন্ত যেতে হয়নি। পথের মধ্যেই মোটা টাকায় দফরফা হয়। পরে ওসি আজমগীর তাকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
থানার ওসি আজমগীর হোসাইন বলেন, এখন পর্যন্ত ১৪-১৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। আমরা টাকা নিয়ে আসামি ছেড়েছি এই তথ্য সঠিক নয়।
পুলিশ গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে ২০২৩ সালে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা একটি পুরাতন মামলায়। গত ১৮ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত ১০ দিনে এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে গেছেন ১১ জন। এই বাইরে গ্রেফতার করে চালান করার ভয় দেখিয়ে বাণিজ্য করা হয়েছে আরও অন্তত্য ৫ জনের সঙ্গে।
পুরোনো মামলায় গ্রেফতার নিয়ে ওসি রাজেশ কুমার চক্রবর্তী বলেন, আমি নজর দেওয়ার চেষ্টা করি। কেউ টাকা নেওয়ার অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।
নাশকতা মামলায় ফোঁকফোকর
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক নাশকতা চালানো হয়। বগুড়া সদরে ও শেরপুরে পুলিশের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় ২৯ জুলাই পর্যন্ত বগুড়া সদরে মোট ১৪টি এবং শেরপুরে ১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে ১০টি মামলার বাদী পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে স্পর্শকাতর ও সহিংস অনেক ঘটনার মামলার বাদী হয়েছে তারা। তবে আলোচিত এই মামলাগুলোতে নানা ফাঁকফোকর রয়েছে বলে জানিয়েছেন অপরাধ বিষয়ক আইনজীবীরা।
তারা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অধিকাংশ মামলাতেই জব্দ তালিকা নগন্য। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালানোর বিষয় উল্লেখ করা হলেও তেমন কিছু জব্দ দেখানো হয়নি। অজ্ঞাতনামার কোনো সীমা নেই। নামধারী আসামিদের পুলিশ কীভাবে সুনির্দিষ্ট করলো তারও উল্লেখ নেই। এজাহারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা প্রদানের কথা বলা হলেও সেটা কীভাবে তা উল্লেখ নেই। এতো কিছু ঘটনা ঘটলো অথচ পুলিশ ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু কেন বাধা দিলো সেটিও উল্লেখ করা হয়নি।
আইনজীবীরা বলেন, একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে এটি নিশ্চত। কিন্তু পুলিশের অভিযোগগুলো একেবারেই দায়সারা। এটি প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট উপাদান বর্ণনা মামলায় নেই। আদালতে জেরা চলাকালে এই অভিযোগ সাজানো বলে প্রতিয়মান হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রায় সব মামলাতেই সুনির্দিষ্ট সাক্ষির কোনো বর্ণনামূলক বক্তব্য নেই। ক্ষতির পরিমাণ টাকার অংকে উল্লেখ করা হলেও সেটি কিসের ভিত্তিতে কোন বিশেষজ্ঞ নির্ধারণ করেছেন তারও উল্লেখ নেই। পুলিশ শত শত রাউন্ড গুলি ও টিআর সেল নিক্ষেপের কথা বললেও এগুলো দিয়ে কী ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তারও উল্লেখ করা হয়নি মামলায়।
বগুড়া জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল বাছেদ বলেন, পুলিশ বিএনপিকে দমন করার উদ্দেশ্যে নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালাচ্ছে। বাড়িতে থেকেও আসামি হয়ে গেছেন তারা। অভিযানে সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলায় চালান দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। সেই আতঙ্কে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও বাড়িঘর ছাড়া। এখন পর্যন্ত অন্তত শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে।
জামায়াতের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, দুপচাঁচিয়া উপজেলা জামায়াতের আমীর মুনসুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অনেককে গ্রেফতার করার কথা বলে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এই আতংক তাদের পরিবারের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বগুড়া সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শাহিনুজ্জামান বলেন, ২৯ জুলাই পর্যন্ত সদরে ১৪টি মামলায় মোট ১১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই তালিকায় আরও ৪ জনকে অপেক্ষমান হিসেবে রাখা ছিল। গ্রেফতার হওয়া প্রত্যেকেই বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্য কোনো সাধারণ মানুষকে থানায় আনা হলে যাচাই বাছাই করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদের কাছে প্রায় প্রতিদিনই থানা থেকে ফোন আসছে। তাদেরকে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নাম ঠিকানা দিতে বলা হচ্ছে।
একজন চেয়ারম্যান বলেন, যে কাজটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার করার কথা, সেটি আমাদের করতে বলা হচ্ছে। এতে করে বিব্রত বোধ করছি আমরা। কারণ ইউনিয়ন পর্যায়ে সব ধরনের মানুষকে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হয়। পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। এতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের জড়িয়ে ফেললে কেমন লাগে।
একই ধরনের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা। পুলিশের এই আহ্বানে অনেকেই নামের তালিকা নিয়ে থানায় হাজির পর্যন্ত হচ্ছেন বলেও জানান তারা।
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, আগে থেকেই মামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীরা। সিনিয়র নেতাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। কারো কারো মামলার সংখ্যা শতাধিক। আদালতে হাজিরা দিতে দিতেই দিন কাটে। এ অবস্থায় নতুন মামলা বিপাকে ফেলে দিয়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে শহর ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। অনেকেই চলে গেছেন আত্মগোপনে। থাকছেন না বাসাবাড়িতে। বন্ধ করে রেখেছেন মোবাইল ফোন। কর্মীদের সঙ্গে সিনিয়র নেতাদের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। যে যেভাবে পারছেন, কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে গ্রেফতার এড়ানোই এখন তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা অভিযোগ করে বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত না থাকলেও অনেক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, ঘরে ঘরে তল্লাশি ও হয়রানি করা হচ্ছে। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে না পেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
এদিকে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় শহরের খান্দার এলাকার রেজভী আহমেদ নামের এক তরুণ দাবি করেছেন, ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি বাসাতেই ছিলেন। এইচএসসি পাসের পর ২০১৯ সালে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনার জন্য চীনে যান রেজভী আহমেদ। চীনের ইয়াংজু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পাসের পর এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফেরেন। বৃত্তিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের লামার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেয়েছেন। ভিসার জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই বিস্ফোরক মামলার আসামি হয়ে গেছেন তিনি।
এছাড়া এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতিতে থাকা লায়লাতুন নাজিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাকি তাজওয়ার, ছাত্র ইউনিয়ন বগুড়া জেলা সংসদের সাবেক সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সেউজগাড়ি বন্দর কমিটির সম্পাদক শাওন পাল ছাড়াও কয়েকজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিককে বগুড়া শহরের নাশকতা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করার বিষয়ে মামলার বাদী ও জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ভিডিও দেখে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে। ভুল ভ্রান্তি হতে পারে। পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।