ঢাকা
২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রাত ২:৩৩
logo
প্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০২৪
আপডেট: আগস্ট ২৪, ২০২৪
প্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০২৪

বন্যার মূল কারণ অল্প সময়ের মধ্যে অতি মাত্রায় ভারি বৃষ্টিপাত

কুমিল্লার দেবীদ্বার পয়েন্টে গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় গোমতী নদীর পানির সমতল ছিল ৮.৫৮ মিটার, যা বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপরে। একই সময়ে নদীর পানি কুমিল্লা পয়েন্টে বইছিল ১২.৪৮ মিটার উচ্চতায়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৯৮৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়কালে গোমতীর পানি এতটা উচ্চতায় পৌঁছেনি।

গোমতীর মতো উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের একাধিক নদ-নদীর পানি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে গত কিছুদিনে।

নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বাংলাদেশের উজানে অবস্থিত ভারতের ত্রিপুরাসহ কয়েকটি রাজ্যে অল্প সময়ে অতিমাত্রায় ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেই আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই অঞ্চলগুলোতে।

হালদা নদের পানি চট্টগ্রামের নারায়ণহাট পয়েন্টে গতকাল সকাল ৯টায় ১৫.৯০ মিটার এবং পাঁচপুকুরিয়া পয়েন্টে ৯.৪২ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছিল। চট্টগ্রামের রামগড় পয়েন্টে ২২ আগস্ট সকাল ৯টায় ফেনী নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১৯.৮ মিটার। দুটি নদীর ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পয়েন্টে পানির স্তর ছিল গত ৩৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেটসহ বেশ কিছু জেলায় এই হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ভারতের উজানের রাজ্যগুলো, বিশেষ করে ত্রিপুরার অতিবৃষ্টি ও বন্যা। গত কিছুদিনে বাংলাদেশের এই অঞ্চলগুলোতেও অতিমাত্রায় ভারি বর্ষণ হয়েছে। তবে আবহাওয়াবিদ, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের এই অঞ্চলগুলোতে বন্যার পেছনে উজানের বৃষ্টিই বড় ভূমিকা রাখে। দেশের অভ্যন্তরের বৃষ্টিপাতের ভূমিকা এখানে কম।

বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। এই রাজ্যে গত কিছুদিন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া মিজোরাম ও মেঘালয়ের মতো বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য বা অঞ্চলগুলোতেও সম্প্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

ভারতের আবহাওয়াবিষয়ক সরকারি সংস্থা আইএমডির ১৫ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত রাজ্যভিত্তিক বৃষ্টিপাতের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময়ে ত্রিপুরায় গড়ে ৩১৪.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৯৮ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত ভারতের আরেক রাজ্য মিজোরামে এ সময় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৭ শতাংশ এবং উত্তরে সীমান্তবর্তী রাজ্য মেঘালয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি ছিল।

গত কিছুদিনের বৃষ্টিপাতের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমডি এই রাজ্যগুলোকে গাঢ় নীল রঙে চিহ্নিত করেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে ৬০ শতাংশ বা এর বেশি বৃষ্টি হলে আইএমডি সেটাকে ‘লার্জ এক্সেস’ বা অতিমাত্রায় বেশি বৃষ্টি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে মানচিত্রে গাঢ় নীল রঙে চিহ্নিত করে।

এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত শুধু ফেনীর পরশুরামেই ৩০৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এদিন কুমিল্লায় ২১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সিলেট, মৌলভীবাজার, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৫০ থেকে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। একই সময়ে ভারতের মেঘালয়ের বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জিতে ৩২০ মিলিমিটার এবং ত্রিপুরার অমরপুরে ২৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ত্রিপুরার অন্য অঞ্চলগুলোতেও এ সময় গড়ে ১৫০ মিলিমিটারের ওপর বৃষ্টি হয়।

২১ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ২১৫ মিলিমিটার, মৌলভীবাজারে ১৭৫ মিলিমিটার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। এ সময় ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৩০৩ মিলিমিটার এবং ত্রিপুরার আগরতলায় ১৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, ২৪ ঘণ্টায় ৮৯ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হলে সেটাকে অতিভারি বর্ষণ বলা হয়। গত কিছুদিনে চট্টগ্রাম বিভাগসহ দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে এর চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি বর্ষণও হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেউ কেউ বলছেন, ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থিত গোমতী নদীর ওপর থাকা ডম্বুর জলাধারের গেট খুলে দেওয়ায় এই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক বন্যায় ডম্বুর জলাধারের কিছু ভূমিকা থাকলেও মূল কারণ অতিবৃষ্টি।

এ নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ডম্বুর জলাধারের গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে হঠাৎ বন্যা হয়েছে—এ কথা সঠিক নয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অভিন্ন গোমতী নদীর ক্যাচমেন্ট (নদীতে যেদিক থেকে বৃষ্টির পানি নামে) এলাকায় কয়েক দিন ধরে বছরের সবচেয়ে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে এই ক্যাচমেন্টের পানি স্বাভাবিকভাবেই ভাটির দিকে নেমে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে বলেছেন, জলাধার থেকে পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোর বিষয়টি ভারত এবার প্রতিপালন করেনি। গতকাল হবিগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উজানের দেশে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ায় পানি ছেড়ে দিতে হলে ভাটির দেশকে আগে জানাতে হয়। এতে ভাটির দেশের লোকজন প্রস্তুতি নিতে পারে। কিন্তু এবার এই জানানোর বিষয়টি ভারত প্রতিপালন করেনি।

বাংলাদেশে নদী ও পানি বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাগজে-কলমে ও মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আইনুন নিশাত। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, খাগড়াছড়িসহ বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলো ভারত সীমান্তের লাগোয়া। এসব অঞ্চলসংলগ্ন ভারতের উজানের অংশে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশেও কিছুটা হয়েছে। মূলত অতিবৃষ্টির প্রভাবেই এই বন্যা।’

শুধু কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধির পেছনে ডম্বুর জলাধারের কিছুটা ভূমিকা আছে বলে জানান আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘ডম্বুর জলাধারের কিছুটা প্রভাব গোমতী নদী এলাকায় পড়েছে। তবে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে মূলত অতিবৃষ্টির কারণেই। জলাধারটি না থাকলেও এই অঞ্চলগুলোতে বন্যা হতো। ডম্বুরের গেট খুলে দিলে হয়তো পাঁচ ফুট পানি হতো, না খুললে চার থেকে সাড়ে চার ফুট।’

আইনুন নিশাত বলেন, গোমতী নদীতে নির্মিত ডম্বুর জলাধারের গেট খোলার সঙ্গে মুহুরী বা ফেনী নদীর পানি বৃদ্ধি কিংবা মৌলভীবাজার ও খাগড়াছড়ির বন্যার সম্পর্ক নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, মূলত অতিবৃষ্টির ফলে এই বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সক্রিয় মৌসুমি বায়ু এবং সাগরের লঘুচাপের কারণে বৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে আরো কিছু বিষয়ও কাজ করেছে। ভারতের ত্রিপুরাসহ উজানের প্রবল বৃষ্টিপাতের পানি ঢল আকারে সংলগ্ন বাংলাদেশের অঞ্চলগুলোতে নেমে এসেছে।

উদয় রায়হান বলেন, ‘ফেনীর পরশুরামে মুহুরী নদীতে এ বছরের ২ আগস্ট পানির উচ্চতা ১৪.২০ মিটারে পৌঁছেছিল। তখন কিন্তু এমন তীব্র বন্যা হয়নি। এবার পানি এর চেয়ে অনেক নিচে হলেও (২১ আগস্ট ১৩.৪২ মিটার ছিল নদীর পানি) বন্যা অনেক তীব্র হয়েছে। এর কারণ হলো উজানে, বিশেষ করে ত্রিপুরায় পানির উচ্চতা অনেক অতীত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই কারণে প্রভাবটাও বেশি পড়েছে সামগ্রিকভাবে।’

উদয় রায়হান আরো বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে ভারতের বাঁধের বিষয়ে কোনো তথ্য আদান-প্রদান হয় না। তবে বৃষ্টিপাত ও পানিপ্রবাহের তথ্য নিয়মিতই পাঠায় ভারত।

এ ধরনের আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও সৃষ্টি হতে পারে উল্লেখ করে আইনুন নিশাত করণীয় সম্পর্কে বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের পূর্বাভাসপদ্ধতি বদলাতে হবে, যাতে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কারণ এখন থেকে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এ ধরনের বন্যা আরো হতে পারে। এ জন্য পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন। তৃতীয়ত, পুনর্বাসনের ব্যাপারে এখনই চিন্তা করতে হবে।’

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram