যশোর প্রতিনিধি: কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর আবারও ফল আমদানি বেড়েছে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে। ওজনের কারচুপির মাধ্যমে আমদানিকারকরা লাভবান হওয়ার কারণেই বেনাপোল বন্দর ছেড়ে ভোমরা বন্দরে ঝুঁকছেন বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।ফলে, একদিকে যেমন রাষ্ট্র হারাচ্ছে রাজস্ব, তেমনই লাভবান হচ্ছেন আমদানিকারক ও বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আমদানিকারক ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বেনাপোল স্থলবন্দরে ডিজিটাল ওয়েট (ওজন) স্কেল। অপরদিকে ভোমরা বন্দরে ব্যবহার করা হয় ম্যানুয়াল ওজন স্কেল। সেই ক্ষেত্রে ওজনের একটা বিরাট তারতম্য ঘটানো সম্ভব হয় সেখানে ওজনের ক্ষেত্রে। আর সেকারণেই এটি লুফে নিচ্ছে আমদানিকারকরা। কারণ, এই ওজন স্কেলের মাধ্যমে তারা আমদানিকৃত পণ্যের বিরাট অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিতে সক্ষম হচ্ছে। আর এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত খোদ ভোমরা স্থলবন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তারা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে আপেল ভর্তি একটি ট্রাক (পিবি১৩বিটি-২০১১) ঢোকে ভোমরার বিপরীতে ঘোজাডাঙ্গা বন্দরে। সেখান থেকে আরেক ভারতীয় ট্রাকে মাল লোড করা হয়। এরপর সেই ট্রাক ভোমরা বন্দরে ঢোকে ১৮ সেপ্টেম্বর। ট্রাকে থাকা আপেলের ওজন (ক্যারেটসহ) ছিল ২৮ হাজার ৯২০ কেজি। কিন্তু ভোমরা বন্দরের ওজন স্কেলে মাপা হয় ২৭ হাজার ৮২৮ কেজি। অর্থাৎ, এখানে ওজন কারচুপি হয়েছে ১ হাজার ৯২ কেজি।
এই পণ্যের আমদানিকারক ছিলেন সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকার মেসার্স পারভেজ ট্রেডার্স। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ভারতের মেসার্স বিশাল ফ্রুটস এজেন্সি। আর এই পণ্যটির খালাসের দায়িত্বে ছিল মেসার্স আল মদিনা।
অপরদিকে, একইদিন আপেলভর্তি আরেকটি ট্রাক আসে ভারত থেকে। সেখানে ক্যারেটসহ ওজন ছিল ২৭ হাজার ৫৮২ কেজি। ভোমরা বন্দরের ওজন স্কেলে সেটি দেখা যায়,নিট ২১ হাজার কেজি। এই পণ্যটির প্যাকেজের সংখ্যা ছিল ৩২৯১.০০।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতীয় গাড়িতে নির্ধারিত প্যাকেজের (মালের সাথে থাকা ক্যারেট বা কার্টন) চেয়ে অতিরিক্ত প্যাকেজ দেখালে আমদানিকৃত পণ্যের ওজন কম দেখানো যায়। ভোমরা বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্টরা এই অপকর্মটি করে থাকেন। যেমন ভারত থেকে ট্রাকে আসা আপেল বা টমেটো ভর্তি ক্যারেটের সংখ্যা তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০টির অধিক নয়। কিন্তু সেখানে এই সংখ্যা দেখানো হয় ৩২শ’ থেকে ৩৩শ’ পিস। সেকারণে প্যাকেজের সংখ্যা বাড়ালে পণ্যের ওজনও কমে যায়, আর ওজন কমলে সরকারের রাজস্ব কম হয়।
বন্দর ব্যবহারকারীরা জানায়,চলতি সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় প্রতিদিন ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ৭৫-৮০ ট্রাক পেরিশেবল(পচনশীল) পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। অপরদিকে, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মাত্র ২০ থেকে ২৫ ট্রাক পেরিশেবল(পচনশীল) পণ্য আসছে।
আমদানিকারকরা ভোমরা বন্দর ব্যবহারের ফলে ট্রাকপ্রতি দেড় থেকে দুই টনের বেশি শুল্ক ফাঁকির সুযোগ পাচ্ছেন। সে কারণে তারা এই বন্দর ব্যবহারে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আর সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী বলেন, চলতি মাসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ফল আমদানি খুবই কম। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় বেশির ভাগ আমদানিকারক ভোমরা বন্দর ব্যবহার করছেন। এভাবে চলতে থাকলে বেনাপোল বন্দর দিয়ে যে রাজস্ব আদায়ের সুনাম আছে, তা আর থাকবে না এ ব্যাপারে তিনি শুল্ক গোয়েন্দাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
আরও একজন সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী রিয়েল ইন্টারন্যাশনাল বলেন,ভারতের নির্দিষ্ট কিছু ট্রাক আছে। যেসব ট্রাকের ওজন দেড় থেকে দুই টন কম দেখিয়ে এন্ট্রি করা হয়। এরফলে মালের পরিমাণ বেশি এনে কম দেখানো এবং শুল্ক পরিশোধে অবৈধ সুযোগ নেওয়া যায়। তিনি জানান, আপেল,আনার, কাঁচা মরিচ ইত্যাদির আমদানি এখন ভোমরা বন্দর দিয়ে বেশি হচ্ছে। ওজন স্কেলে ফাঁকি দিতে পারায় আমদানিকারকরা সেদিকিই ঝুঁকছেন। এভাবে চলতে থাকলে বেনাপোল স্থল বন্দর মুখ থুবড়ে পড়বে সরকারও রাজস্ব হারাবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোমরা স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ইন্ডিয়ান ওজন কারচুপির উপরে আমাদের কোনো ডিপেন্ডেন্সি নাই। আমাদের ওজন স্কেলে যে ওজন হয়, আমরা সেই ওজনই ধরবো। ভোমরা বন্দরে ওজনে সামান্যতম বিন্দুমাত্র কোনো কারচুপি করা হয় না।
খুলনা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোঃ আতিকুজ্জামানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ওজন স্কেলের কারচুপি নিয়ে যে অভিযোগটি উঠেছে এটি সত্য নয়, ভোমরা বন্দরে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য বোঝায় ট্রাক সরকারের বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শতভাগ পণ্যের ওজন করা হয়। ওজনে কারচুপি করার কোন সুযোগ নেই।