যশোরের সফটওয়্যার পার্কটি এখনো পরিচালনা করছে ‘টেকসিটি’ নামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এটি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু পরিচয়দানকারী তথ্য-প্রযুক্তি খাতের অন্যতম অলিগার্ক (লুটেরা) ওয়াহেদ শরীফের মালিকানাধীন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইসিটি বিভাগ টেকসিটির কাছ থেকে পার্কটি ‘উদ্ধারের’ সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুই মাস পার হলেও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
হাসিনা সরকারের বিদায়ে ‘লুটেরা কম্পানি’ টেকসিটি কোণঠাসা হয়ে পড়লেও কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তায় লুটেরারা আবার পার্কে অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করছে। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় উদ্যোক্তারা। সূত্র জানায়, টেকসিটির ব্যবস্থাপনা এখনো ‘জয়ের বন্ধুর’ কবজায় যশোর সফটওয়্যার পার্কপরিচালক বিতাড়িত সরকারের সময় ওয়াহেদ শরীফের মালিকানাধীন ‘ডিজিকন’ নামের প্রতিষ্ঠানটি তথ্য-প্রযুক্তি খাতে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার ছাড়াও গুরুতর অনিয়মে জড়িত ছিল। কিন্তু ওয়াহেদ শরীফ নিজেকে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু পরিচয় দিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে দিনকে রাত করতে পারতেন।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বহুল আলোচিত জুনাইদ আহমেদ পলকও ওয়াহেদ শরীফের কথার বাইরে যাওয়ার সাহস রাখতেন না। ফলে ওই দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েন। বিষয়টি আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে ওপেন সিক্রেট ছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিক্ষুব্ধ জনতা তৎকালীন শেখ হাসিনা সফটওয়্যার পার্কের দিকে এগিয়ে গেলেও সেই সময় স্থানীয় উদ্যোক্তারা পার্কটি রক্ষা করেন।
পরদিন স্থানীয় কয়েক তরুণ পার্কটিতে হানা দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীদের খুঁজতে থাকেন। পার্কটির ডরমিটরিকে অবৈধভাবে হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে রূপান্তরের কারিগর খান প্রপার্টিজের মালিক মাসুদ খান সেদিন ছদ্মবেশে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন।
পার্কটির উদ্যোক্তাদের সংগঠন সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, যশোর ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (এসটিপিজেআইএ) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহজালাল জানান, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পার্কটি রক্ষায় ছাত্র-জনতার মনোভাবের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাঁরা শেখ হাসিনা সরকারের অলিগার্কদের বিদায় করার দাবি জোরালো করেন। পরে ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন, মিছিল-মিটিংও করে। তাঁরা দাবি তোলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রীর নাম বাদ দিয়ে পার্কটির নাম দিতে হবে, এমটি ভবনের নাম শহীদ মুগ্ধর নামে করতে হবে, টেকসিটির সঙ্গে করা গণবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে, টেকসিটির কর্তৃত্ব যত দ্রুত সম্ভব খর্ব করে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে পার্কের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, জনগণের করের টাকা ও বিশ্বব্যাংকের ঋণে (যা সুদে-আসলে জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে) পার্কটি নির্মিত হলেও এখান থেকে অর্জিত রাজস্বের মাত্র ১৮ শতাংশ পায় বাংলাদেশ সরকার আর যে কম্পানির কোনো বিনিয়োগ নেই, সেই টেকসিটি নিয়ে যায় ৮২ শতাংশ। গত ২৮ আগস্ট আইসিটি ডিভিশনের একটি সভা হয়, যেখানে তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় পার্কটির নামবদল এবং লুটেরা কম্পানি টেকসিটিকে বিদায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আইসিটি বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মনির হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটিও গড়ে দেন উপদেষ্টা নাহিদ। কিন্তু দুই মাসেও সেই কমিটি কাজ শেষ করতে পারেনি। এই কমিটির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. তবিবুর রহমান বলেন, এরই মধ্যে কমিটির তিনটি সভা হয়েছে। দালিলিক বিষয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। শিগগিরই উদ্যোক্তা ও টেকসিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে যশোরে বসা হবে। ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক এ এইচ এম আরিফুল হাসনাত বলেন, আইসিটি বিভাগ টেকসিটিকে খারিজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাদের সংগঠনের সদস্যদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এখন থেকে যাবতীয় লেনদেন হবে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু বিল পরিশোধের জন্য হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তারা আজ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব নম্বর দেয়নি। ফলে স্পেস রেন্ট ও বিদ্যুৎ বিলের বোঝা বাড়ছে উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে। এসব বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এমডি এ কে এম আমিরুল ইসলামের সরকারি নম্বরে কয়েক দফা ফোন করা হলেও প্রতিবারই তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ফোন ধরে পাবলিক রিলেশন অফিসারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। অভিযোগ রয়েছে, আমিরুল সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলেন। যশোরের নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তারা সম্প্রতি পর পর দুই দিন আগারগাঁওয়ের দপ্তরে হাজির হয়েও এমডির সঙ্গে কথা বলতে পারেননি বলে জানান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক।