পৃথিবীর সমগ্র আয়তনের ৭১ শতাংশ জুড়ে আছে জলভাগ এবং মাত্র ২৯ শতাংশ জুড়ে আছে স্থলভাগ। এই বিশাল জলরাশির প্রায় ৯৬.৫ শতাংশে আছে যেই সমুদ্র, সেই সমুদ্র নিয়ে সমগ্ৰ বিশ্বের উদ্বেগ এবং সঠিক ধারনা নেই বললেই চলে। এরই সূত্র ধরে, সমুদ্র বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমুদ্র সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে বৈশ্বিক রুপদান করতে কতিপয় সমুদ্রকেন্দ্রিক সংস্থা এবং তাদের প্রকল্পসমূহের নিরলস প্রচেষ্টার পর ২০০৮ সালে জাতিসংঘ ৮ই জুনকে বিশ্ব সমুদ্র দিবস হিসেবে ঘোষনা দেয়। আজ সেই ৮ই জুন, ২০২৪। ১৬ তম সমুদ্রদিবস হিসেবে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও কিছু লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি মূল প্রতিপাদ্য বিষয় স্থাপনা করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ”আমাদের সমুদ্র এবং জলবায়ুর জন্য সুপরিকল্পিত কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা"। পৃথিবীর আবহাওয়া, জলবায়ু এবং সমুদ্রের মধ্যে যে বিশেষ সংযোগ রয়েছে, তার ধারনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, সমুদ্রের ক্রমাবনতির অবসান ঘটিয়ে সঠিক উদ্যোগের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোই ছিলো এই প্রতিপাদ্যের মূল উদ্দেশ্য। যুগোপযোগী এই আন্দোলনের অংশীদার হওয়ার উদ্দেশ্যে এবং সমুদ্র-প্রেমী হিসেবে বিশেষ এই দিবসটি উদযাপনের লক্ষ্যে প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ কিছু অনুষ্ঠান কর্মসূচি পালন করে।
আনন্দ-সমাবেশ এবং অতিথিবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য
প্রথমেই দিবসটি উদযাপনের অংশ হিসাবে কার্জন হল প্রাঙ্গনে একটি বর্ণাঢ্য সমাবেশ আয়োজন করা হয় যেখানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য, অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক ড. মোঃ জিল্লুর রহমান, ডিন, আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, অধ্যাপক ড. মোঃ মনিরুজ্জামান খন্দকার, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ (অবসরপ্রাপ্ত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক ড. সুব্রত কুমার সাহা, চেয়ারম্যান, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক ড.অমূল্য চন্দ্র মন্ডল, গনিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন ড. কে এম আজম চৌধুরী, চেয়ারম্যান এবং সহকারী অধ্যাপক, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও র্যালিটিকে আরো মহিমান্বিত করতে উপস্থিত ছিলেন সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. জোবায়ের আলম, ড. মীর শরীফুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অন্যান্য সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ এবং ড. টনিয়া এস্ট্রিড ক্যাপুয়ানো, ফ্রান্সের সুনামধন্য সমুদ্র-গবেষক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিচালনা কেন্দ্ৰে (ICOG) গবেষক হিসেবে কর্মরত,। সভাপতির আহবানে প্রধান অতিথি, উপাচাৰ্য, অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল তার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। জ্ঞানগভীর এই বক্তব্যে তিনি সমুদ্র-গবেষনা কে ভবিষ্যত গবেষণা ক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার অপার সম্ভাবনার নিজস্ব অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেন এবং ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীদের কাছে একাগ্রতা এবং নিরলস প্রচেষ্টায় দৃঢ় থাকার আহবান করেন। বিশেষ অতিথিবৃন্দের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরে বেলুন উত্তোলন কর্মসূচি পালন করা হয়। অতঃপর শুরু হয় র্যালি কার্যক্রম। কার্জন হল থেকে কাজী মোতাহার হোসেন ভবন পর্যন্ত চলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহনকারীদের দৃষ্টিনন্দন এই র্যালি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতবিনিময় সভা এবং প্লাস্টিক পরিষ্কার কর্মসূচি
কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের প্রাঙ্গনে দিনের বিদায়ী কর্মসূচি হিসেবে গ্রহন করা হয় এক অভিনব মতবিনিময় সভার যেখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীবৃন্দ উভয়েই সমুদ্র নিয়ে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে ফুটে উঠে ভবিষ্যতে সমুদ্র-গবেষনা কে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য আশ্বাসের বানী এবং তুলনামূলক নতুন এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রারম্ভিক ভীতি এবং শঙ্কা কিভাবে পরবর্তীতে গর্ব এবং আশ্বাসে পরিনত হয়েছে তার আশাব্যঞ্জক উপাখ্যান। অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কে এম আজম চৌধুরী তার অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির আঙ্গিকে ব্যাখা করেন কিভাবে ওশেন মডেলিং শুধুমাত্র নতুন গবেষনার দ্বারই খুলে দিচ্ছেনা, বরং ভূত ও ভবিষ্যতের নিখুঁত গননার মাধ্যমে আমাদেরকে দিচ্ছে জলবায়ু অনিশ্চয়তার সাথে লড়াই করার একটি দৃঢ় আশ্বাস।
সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ জোবায়ের আলম তুলে ধরেন সমুদ্র কিভাবে সমগ্র বিশ্বের অক্সিজেনের সিংহভাগ উৎপাদন করে আমাদের নিরব মিত্রর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন কিভাবে শুধুমাত্র আমাদের সচেতনতার দ্বারাই আমরা যে যার অবস্থান থেকে সমুদ্র এবং পরিবেশের অবস্থার উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে পারি। প্লাস্টিক এবং পলিথিনের অবাধ "ডাম্পিং" বন্ধ করতে তিনি সবাইকে শুধু উদ্বুদ্ধই করেন নি, বরং শিক্ষার্থীদের নিয়ে সরেজমিনে নেমে গিয়েছেন এনেক্স প্রাঙ্গনে। কিছু সময়ের মধ্যে এনেক্স সংলগ্ন মাঠ এবং রাস্তাঘাটের সকল প্লাস্টিক এবং পলিথিন বর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে তিনি হয়তো এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করে দিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের সকল বিপ্লবের সাথেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওতপ্রোতভাবে সংযোগ রয়েছে। যদি উপস্থিত অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে কয়েকজনও ড. জোবায়ের আলমের আদর্শ এবং দূরদর্শিতা মনে বহন করতে পারে, কার্যকরী "পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ" বিপ্লবের সুত্রপাত আজকের এই কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হয়ে গিয়েছে বললেও খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবেনা। এরইসাথে সমাপ্তি টানা হয় সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত ঘটনাবহুল এই "বিশ্ব সমুদ্র দিবস - ২০২৪" এর।