বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দুতে উঠে এসেছে ভারতের উত্তর প্রদেশের সম্ভলের শাহী জামা মসজিদ, রোববার (২৪ নভেম্বর) সকালে যা কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল। শতাব্দী প্রাচীন শাহী জামা মসজিদে দ্বিতীয় দিনের সমীক্ষাকে ঘিরে রোববার তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়।
বিবিবিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে সেখানে তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই সংখ্যা সোমবার আরও এক জন বেড়েছে।
মোরাদাবাদ রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মুনিরাজ জি সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, গতরাতে আমরা তিনজন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও, মোরাদাবাদে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট চার জনের মৃত্যু হয়েছে।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে ডিআইজি মুনিরাজ জি জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন চেষ্টা করছে।
যে বিষষ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত তা হলো, হিন্দত্ববাদী সংগঠনের দাবি যে ওই মসজিদে এককালে মন্দির ছিল এবং ওই ভবনের স্থাপত্যে তার প্রমাণও রয়েছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে কয়েকজন আবেদনকারীর হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী বিষ্ণু শঙ্কর জৈন।
অন্যদিকে, মুসলিম পক্ষ এই দাবি খারিজ করেছে। তাদের বক্তব্য শতাব্দী প্রাচীন এই মসজিদে তারা বংশপরম্পরায় নামাজ পড়ে এসেছেন। এই ভবনে কখনো মন্দির ছিল না।
এই বিতর্কের জেরে সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কিনা, সেটা যাচাই করে দেখার জন্যই দ্বিতীয় দফায় অ্যাডভোকেট কমিশনারের নেতৃত্বে দল এসেছিল রোববার।
তখন পুলিশ ও বিক্ষুদ্ধদের মধ্যে সংঘর্ষে রোববার তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং বহু পুলিশকর্মীও জখম হন। এদিকে এই পুরো ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক তরজাও শুরু হয়েছে। রাহুল গান্ধী বিজেপিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টার অভিযোগ তুলেছে।
অন্যদিকে, সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের প্রেসিডেন্ট ও সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসিও সম্ভলের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন।
সোমবারের পরিস্থিতি
সোমবার কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে উত্তর প্রদেশের সম্ভলস্থিত শাহী জামা মসজিদ ও তার সংলগ্ন এলাকা। সোমবারও ওই অঞ্চলে থমথমে ভাব স্পষ্ট। শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিপুল পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় যোগাযোগের জন্য টু-ওয়ে রেডিও, রোববারের মতো ঘটনা রুখতে মেটাল ডিটেক্টর, ভেহিক্যাল ব্যারিয়ার (যানবাহন না ঢুকতে পারার জন্য তৈরি বাধা) মোতায়েনসহ কড়া নজরদারি ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা রুখতে পুলিশ টহল এলাকায় দিচ্ছে।
ডিআইজি মুনিরাজ জি বলেন, সম্ভলের বর্তমান পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
ডিভিশনাল কমিশনার এ কে সিং সাংবাদিকদের বলেন, (রোববারের) ঘটনায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে সম্ভলের সংসদ সদস্য জিয়া উর রহমান বর্ক এবং একজন স্থানীয় এমএলএ-র ছেলের নামেও এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট রাজেন্দর পেন্সিয়ার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিশ জারি করে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম অনুমতি না নিয়ে কোনও বহিরাগত, কোনও সামাজিক সংগঠনের সদস্য বা কোনও জনপ্রতিনিধি সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।
এদিকে, ‘ডি কে ফাউন্ডেশন অফ ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’-এর পক্ষ থেকে এই সহিংসতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলেছে ওই সংগঠন।
উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে রোববার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে পরিস্থিতি ভাল হলে সেই পরিষেবা আবার চালু করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ডিআইজি মুনিরাজ জি বলেছেন, আগামী সময়ে পরিস্থিতি দেখে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্ভলবাসীর কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা শান্তি বজায় রাখুন।
কী নিয়ে বিতর্ক
কৈলাদেবী মন্দিরের মহন্ত ঋষিরাজ গিরি মহারাজ দাবি করেছেন, সম্ভলের শতাব্দী প্রাচীন ওই মসজিদে একসময় মন্দির ছিল। তার দাবি, ওই ভবনে হরিহর মন্দির ছিল।
গত ১৯ নভেম্বর মহন্ত ঋষিরাজ গিরি মহারাজের মতো একাধিক আবেদনকারীদের হয়ে জামা মসজিদে সমীক্ষার দাবি জানিয়ে সম্ভলের সিভিল জজ সিনিয়র ডিভিশনের আদালতে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী বিষ্ণু শঙ্কর জৈন। প্রসঙ্গত, বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ মামলাতেও হিন্দুপক্ষের হয়ে মামলা লড়ছেন বিষ্ণুশঙ্কর জৈন।
এদিকে, ১৯ নভেম্বর শুনানির সময় আবেদনকারী ছাড়া অপর পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। মসজিদ কমিটি জানিয়েছে, এই মামলার বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি।
একইসঙ্গে, মসজিদের জায়গায় এক সময় মন্দির ছিল এরকম দাবিকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন তারা। তাদের পাল্টা অভিযোগ, আদালতে মামলা দায়ের করে নতুনভাবে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি এবং শিরোনাম দখলের চেষ্টা চলছে।
এই মামলায় সাত দিনের মধ্যে সমীক্ষার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। একইসঙ্গে জরিপের দায়িত্বে থাকা দলকে ভিডিও এবং ফটোগ্রাফিসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এই মামলায় রমেশ সিং রাঘবকে অ্যাডভোকেট কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেছে আদালত।
মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সমীক্ষার বিষয়ে আদালতের নির্দেশের কথা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়। মসজিদ কমিটির সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী জাফর আলী বিবিসি হিন্দিকে বলেছিলেন, আদালত প্রাঙ্গণে আমরা গেরুয়া পোশাক পরা বেশ কয়েকজনকে চলাফেরা করতে দেখে আমাদের সন্দেহ হয় যে কিছু একটা ঘটছে।
“বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সম্ভল পুলিশের তরফে আমাদের বলা হয় যে আমাদের মসজিদ চত্বরে পৌঁছতে হবে কারণ আদালতের নির্দেশে সমীক্ষা চলবে।”
রমেশ সিং রাঘবের নেতৃত্বে ১৯ নভেম্বর বিকেলে প্রথমবার মসজিদে গিয়েছিল জরিপের দায়িত্বে থাকা দল। সেই সময় সম্ভলের পুলিশ সুপার কৃষ্ণ কুমার জানিয়েছিলেন, মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ছিল সেদিনের সমীক্ষা।
তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশে পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতিতে জরিপ সম্পন্ন হয়। সেই সময় কোনও বিশৃঙ্খলা হয়নি। নিরাপত্তার দিক থেকে মসজিদ চত্বরে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
সম্ভলের জেলাশাসক রাজেন্দ্র পেনসিয়া জানিয়েছেন, সেইবার রাত হয়ে যাওয়ায় সমীক্ষা শেষ করা যায়নি। তাই রোববার সমীক্ষার জন্য আবার গিয়েছিল ওই দল।
জেলা শাসক জানিয়েছেন রোববার, জরিপ ভালোই চলছিল, কিন্তু মসজিদের বাইরে পৌঁছে একদল বিক্ষুব্ধ মানুষ হঠাৎই পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয় এবং সহিংসতার ঘটনায় পরিণত হয়।
শাহী জামা মসজিদ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
শাহী জামা মসজিদ, যা সম্ভলের স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জামা মসজিদ নামেই পরিচিত, একটা শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ। সম্ভলের ঐতিহাসিক এই মসজিদ ঠিক কবে নির্মাণ করা হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হিন্দু পক্ষ আদালতে দাবি করেছে যে এটি মুঘল শাসক বাবরের নির্দেশে হিন্দু মন্দিরের জায়গায় এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
সম্ভলের ইতিহাস ‘তারিখ-এ সম্ভল’ বইয়ের লেখক মাওলানা মোঈদ। তিনি বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, বাবর এই মসজিদ মেরামত করিয়েছিলেন। কাজেই এই তথ্য সঠিক নয় যে এই মসজিদ বাবর নির্মাণ করেছিলেন।
তার কথায়, এটা ঐতিহাসিক সত্য যে ১৫২৬ সালে লোধী শাসকদের পরাজিত করে বাবর সম্ভল সফর করেছিলেন। কিন্তু জামা মসজিদ তিনি নির্মাণ করেননি। মাওলানা মঈদের মতে, সম্ভবত তুঘলক আমলে তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ। কারণ তার পর্যবেক্ষণ বলছে মসজিদের নির্মাণশৈলী মুঘল আমলের সঙ্গে মেলে না।
১৯২০ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বা পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এই ভবনকে সুরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটা জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন ভবনও বটে। আপাতত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই মসজিদের জরিপ চলছে।