ঢাকা
১৯শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৬:২৪
logo
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৪

ফেলানী থেকে স্বর্ণা: সীমান্ত হত্যার শেষ কোথায়?

মায়ের সঙ্গে ভাইকে দেখতে ভারতের ত্রিপুরায় যাওয়ার সময় বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণ গেল ১৪ বছর বয়সি স্বর্ণা দাসের৷ পতাকা বৈঠক করে লাশ ফেরত আনা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের তরফ থেকে হত্যাকাণ্ডের শক্ত কোনো প্রতিবাদের কথা জানা যায়নি৷

১৫ বছর বয়সি ফেলানী খাতুন বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণ হারায় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে৷ সেই ঘটনার সাড়ে ১৩ বছর পর স্বর্ণাকে গুলি করে হত্যা করা হলো৷

নিহত স্বর্ণা মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনীগড় গ্রামের বাসিন্দা পরেন্দ্র দাসের মেয়ে৷ সে স্থানীয় নিরোদ বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো৷

স্বর্ণার ভাই পিন্টু দাস বলেন, ‘মা আর বোনের সীমান্তের ওপারে যাওয়ার কথা ছিল না৷ আমার বড় ভাই সকালে সীমান্তে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল৷ কিন্তু দালালদের চাপে পড়ে মা আর বোন রাতের আঁধারে সীমান্তে গিয়েছিল৷ আমার বোন প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু দালালরা সেটা শোনেনি৷ সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের ভেতরেই আমার বোনকে গুলি করা হয়েছে৷ মা তখন পাশে একটি ডোবায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বাঁচেন৷ বোনই তাকে ডোবার মধ্যে ঝাঁপ দিতে বলেছিল বলে মা আমাদের জানিয়েছেন৷’

পিন্টু জানিয়েছেন, তার মা সঞ্জিতা রানী দাস এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে৷ তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ বাবা পরেন্দ্র দাসও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ সন্তানের লাশ নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন মা৷ কিন্তু জ্ঞান হারানোর কারণে লাশ নিয়ে আসতে পারেননি৷

পিন্টু বলেন, ‘আমার মামা আর বড় ভাই ত্রিপুরায় বসবাস করে৷ মা আর বোন দুই দালালের সহযোগিতায় লালারচক সীমান্তে তাদের দেখতে গিয়েছিলেন৷’

জানা গেছে, তাদের সঙ্গে আরো ছিলেন চট্টগ্রামের এক দম্পতি৷ রাত ৯টার দিকে তারা ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গেলে বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালান৷ এতে ঘটনাস্থলেই স্বর্ণা নিহত হয় এবং চট্টগ্রামের দম্পতি আহত হয়৷ সেই দম্পতিকে চিকিৎসার জন্য সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন৷ হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে স্বর্ণার লাশ হস্তান্তর করে বিএসএফ৷ পিন্টু জানিয়েছেন, তারা চার ভাই বোন৷ তার বড় এক ভাই দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ত্রিপুরায় থাকেন৷ ওই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই মা আর বোন গুলির মুখে পড়েন৷

স্বর্ণার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিবাদের কথা জানা যায়নি৷

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিষয়টি মিডিয়ায় দেখার পর আমরা প্রতিবাদ করেছি৷ এভাবে নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ জানানোর জন্য আমরা সরকারকে বলেছি৷ সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে শক্ত প্রতিবাদ করা, যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে৷’

ফেলানী কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে তার বাবার সঙ্গে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরছিল আর স্বর্ণা দাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে তার মায়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় অভিবাসী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল৷ ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলে ছিল কাঁটাতারের বেড়ায়৷ কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশ প্রবল আলোড়ন তুলেছিল দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে৷ কিন্তু এ রকম আলোড়নের পরও শাস্তি হয়নি ফেলানীকে হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যের৷ বিএসএফের আদালত তাকে বেকসুর খালাস দেয়৷ এরপর মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গড়ালেও অপরাধীর কঠোর সাজা হয়নি৷

তাহলে সীমান্তে এই ধরনের হত্যা বন্ধের বিষয়ে আলোচনা সম্পর্কে ফেলানী-হত্যা মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, ‘আমার মনে হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনো ঠিক করতে পারেনি তাদের কোনটা আগে করা প্রয়োজন৷ ঠিক আছে, এক্ষুনি প্রতিবাদ করেনি, কিন্তু এই ঘটনায় তাদের শক্ত প্রতিবাদ জানানো উচিত৷ বিগত সরকার নানা ধরনের বাহানায় এসব হত্যাকাণ্ডে কোনো প্রতিবাদ করেনি৷ এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অসম্মানের৷ আন্তর্জাতিক নানা জায়গায় এ বিষয়ে আমাদের সোচ্চার হওয়ার সুযোগ আছে৷ বিশ্বের যেসব দেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত আছে, সেখানে সীমান্ত দিয়ে একটু আধটু মানুষ আসা যাওয়া করে৷ কিন্তু কোথায় নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে গুলি করে মারা হয় না৷’

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রায় নিয়মিতই সীমান্তে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে৷ দুই বৈরী প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গোলাগুলি কিংবা হত্যাকাণ্ড বিরল নয়৷ কিন্তু পরস্পরকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধু দাবি করে আসা দুই দেশের সীমান্তে একটি দেশ কর্তৃক নিয়মিতভাবে অন্য দেশের নাগরিককে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷

বেসরকারী মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালে ৩১ জন বাংলাদেশি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন৷ ২০২১ ও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ২৩৷ আসকের হিসাবে এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১১ বছরে ৫২২ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে মারা গেছেন৷ এ বছরও ১৫ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে৷

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দফায় দায়িত্ব পাওয়া স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গত ১৩ আগস্ট পিলখানায় গিয়ে বলেছিলেন, ‘বিজিবির মতো ফোর্সকে সীমান্তে পিঠ দেখাতে বলা হয়েছিল৷ সীমান্তে বাংলাদেশের লোক মারে, আর বিজিবিকে ফ্ল্যাগ মিটিং করতে বাধ্য করা হয়৷ সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি বিজিবিকে বলেছি, পিঠ দেখাবেন না৷ এনাফ ইজ এনাফ, আর নয়৷’

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘এভাবে তারা গুলি করে মানুষ মারবে আর আমরা কোনো প্রতিবাদ করবো না সেটা তো হয় না৷ সরকারকে অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে হবে৷ ১ সেপ্টেম্বর রাতে যে মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করা হলো, তার হাতে তো কোনো অস্ত্র ছিল না৷ তাহলে তাকে কেন গুলি করে মারতে হবে? কেউ যদি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, তাকে গ্রেপ্তার করুন, আদালতে সোপর্দ করুন৷ বিচার হবে৷ মারতে হবে কেন? অন্য কোনো দেশের সীমান্তে তো এভাবে মানুষকে হত্যা করা হয় না৷ তাহলে তারা আমাদের ভালো প্রতিবেশী কিভাবে হলেন? এগুলো বিশ্লেষনের সময় এসেছে৷’

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram