মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুসা মারা বলেছেন, “আমাদের দেশগুলো ও অঞ্চলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়তে হয়। আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, বিশ্বমানচিত্রে আমাদের কোনো বন্ধু নেই, আমাদের স্বার্থ আছে। আফ্রিকার দেশ, বাংলাদেশসহ সবার ‘না’ বলতে শেখা উচিত।”
মুসা মারা বলেন, ‘আমাদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কী স্বার্থ এবং তা কিভাবে অর্জন করতে হবে, তা আমাদের জানতে হবে।
আমাদের লক্ষ্যপূরণে কে সহযোগিতা করতে পারে তা আমাদের বুঝতে হবে। বাণিজ্য, ব্যবসা, বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই আমাদের তা বুঝতে হবে।’
গতকাল সোমবার ঢাকায় বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন (বিওবিসি) সম্মেলনের সমাপনী আলোচনা পর্বে দেওয়া বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন তিনি। ‘সাহায্যের বাইরে : বৈশ্বিক উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে সহযোগিতার নতুন মডেল’ শীর্ষক ওই আলোচনায় অংশ নেন সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরিস তাদিচ, মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুসা মারা, বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার ও সুইজারল্যান্ডের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কোরিন হেনচজ পিগনানি।
মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্য দেশগুলোকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা, দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বেসরকারি খাত অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুসা মারা তার দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘সময় এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মালিতে শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দুই বছর ঠিক করা হয়েছিল।
কিন্তু আমরা এখন চার বছরেরও বেশি সময় অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার অধীনে আছি। আগামী কয়েক মাসে এটি শেষ হবে কি না আমি নিশ্চিত নই।’
মুসা মারা বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্য পূরণ করা; কত সময়ের মধ্যে কোন কোন লক্ষ্য পূরণ করা হবে, তা ঐকমত্যের মাধ্যমে ঠিক করাই সবচেয়ে ভালো। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সব সময় তাড়া থাকে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, নিরাপত্তা বাহিনী মিলে একটি ঐকমত্যের চুক্তি করা।
সেখানে কত দিনে কী অর্জিত হলো, কিভাবে তা যাচাই বা মূল্যায়ন করা হবে তার ব্যবস্থা থাকবে। এরপর নির্বাচন হবে। আমার মনে হয়, এটিই সেরা ব্যবস্থা।’
সুইজারল্যান্ডের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কোরিন হেনচজ পিগনানি বলেন, সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় হলো অংশীদারি। সুইজারল্যান্ডের যেমন স্বার্থ আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশেরও। আলোচনার মাধ্যমে দুই অংশীদার সহযোগিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। এটি একতরফা নয়।
বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক বলেন, ‘গ্লোবাল সাউথ’ ও ‘গ্লোবাল নর্থ’-এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে দক্ষিণ কোরিয়া ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের দৃশ্যত কোনো সমাধান নেই। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সংকট সমাধানে চীন ও ভারতকে আরো ভূমিকা রাখা উচিত। ওআইসিরও আরো ভূমিকা পালন করা উচিত।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত শৃঙ্খলাভিত্তিক বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার ওপর জোর দেন। বৈষম্যকে বিশ্বের জন্য হুমকি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।
সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরিস তাদিচ বলেন, ‘আমাদের নতুন বিশ্বব্যবস্থা দরকার। এটি ছাড়া বহুপক্ষবাদ সফল হবে না। প্রশ্ন হলো, নতুন বিশ্বব্যবস্থা কে বাস্তবায়ন করবে?’ তিনি বলেন, ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা ছাড়া আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার মধ্যে থাকব।
আর এই ব্যবস্থায় কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা নির্দিষ্ট থাকবে না। এ কারণে আমি খুব আশাবাদী নই। তবে অন্তর্বর্তী সময়টা খুব বিপজ্জনক।’
সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এই সরকারের (বাংলাদেশের) অন্তর্বর্তী মেয়াদটাও খুবই বিপজ্জনক সময়। আমি অন্তর্বর্তী সরকারে আমাদের বন্ধুদের কিছু বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পরামর্শ দিয়েছি। প্রথম নিরাপত্তা। নিরাপত্তা খাতে সংস্কার না করায় আমি আমার দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে হারিয়েছি। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন।’
তিনি বলেন, বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু কৌশলগত ক্ষেত্রে আরো গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট নতুন প্রযুক্তি ও ডিজিটাইজেশনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে তা বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্ভর করছে। তবে আমি জানি তাদের কী করতে হবে। সাধারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে তাদের। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
বরিস তাদিচ বলেন, সার্বিয়ায় ১২ বছর গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়নি। ২০১২ সালের পর সার্বিয়ায় স্বাভাবিক নির্বাচনের পরিবেশ নেই। বিরোধী দলগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। কারণ নতুন প্রযুক্তির সুযোগে সবাই নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বরিস তাদিচ জানান, তিনি এই অভিজ্ঞতার কথা ড. ইউনূসকে জানিয়েছেন।