এস এম আব্দুল্লাহ সউদ, কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: জয়পুরহাটের কালাইয়ে টেন্ডার ছাড়াই সরকারি রাস্তার ১২৬৫টি ইউক্যালিপটাস গাছ কাটা হচ্ছে প্রকাশ্যে। গাছ কাটার খবর পেয়েও প্রশাসন নীরব ভূমিকায় রয়েছেন বলে অভিযাগ উঠেছে।
গতকাল রবিবার কালাই উপজলার উদয়পুর ইউনিয়নের দুধাইল-তেলিহার রাস্তায় এসব গাছ কাটা হয়েছে। তেলিহার কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে সাধারণ সম্পাদক তানজির আহমেদ শাকিব এলাকার কয়েকজন দুষ্কৃতিকে সাথে নিয়ে ইউএনও’র মৌখিক নির্দেশে গাছগুলো ঠিকাদারের নিকট বিক্রি করেছেন ৩২ লাখ টাকায় অথচ বন বিভাগের দেওয়া তালিকায় এসব গাছের মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র সাড়ে ১২ লাখ টাকা। টেন্ডার ছাড়া সরকারি রাস্তার গাছ এতো কম দামে বিক্রি হয় কিভাবে তা জানতে চায় এলাকাবাসী। তবে ইউএনও’র ভিন্ন ভাষ্য, রাস্তায় যারা গাছ লাগিয়েছে তারা চাইলে গাছ বিক্রি করতে পারেন। চুক্তি অনুযায়ী টেন্ডার বা ওয়ার্কঅর্ডারের প্রয়োজন নেই।
ইউনিয়ন ও বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের দুধাইল-তেলিহার রাস্তার প্রায় ২ কিলোমিটার বৃক্ষরোপণ করেন তেলিহার কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির সদস্যরা। এ নিয়ে তারা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তিপত্র অনুযায়ী সমিতির সদস্যরা গাছগুলো দেখভাল করেন। পরবর্তীতে যখন গাছগুলো বিক্রি হবে তখন বিক্রি মূল্যের ২০ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদের কোষাগারে এবং ১০ শতাংশ অর্থ জমির মালিকরা পাবেন। এরইমধ্যে গোপনে সমিতির সাধারণ সম্পাদক তানজির আহমেদ শাকিব চেয়ারম্যানের নিকট গাছ কাটার আবেদন করলে, চেয়ারম্যান বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবগত করেন। সে মোতাবেক ইউএনও চলতি বছরের ৬ জুন উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় ওই সড়কের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেন এবং বন বিভাগকে সরেজমিনে গাছের মাপযোগ ঠিক রেখে মূল্য নির্ধারণপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। বন বিভাগ সরেজমিন ১২৬৫টি ইউক্যালিপটাস গাছের নম্বর ও সর্বনিম্ন মূল্য সাড়ে ১২ লাখ টাকা নির্ধারণ করেন এবং চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ইউএনও’র নিকট প্রতিবেদন দাখিল করেন।
নিয়ম অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণের পর গাছগুলো বিক্রির জন্য টেন্ডারের সকল ব্যবস্থা করবেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। কিন্তু ৫ আগস্টের পর উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী পলাতক থাকার কারনে গাছ কাটার জন্য টেন্ডারের ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। এবং এ বিষয়ে ওই ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামও এসবের কিছুই জানেন না। কার্যাদেশ না থাকা সত্ত্বেও ইউএনও’র মৌখিক নির্দেশে সমিতির সাধারণ সম্পাদক এলাকার কয়েকজন দুষ্কৃতিকে সাথে নিয়ে গাছগুলো গোপনে বিক্রি করেছেন।
রবিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তাড়াহুড়া করে ঠিকাদারের শ্রমিকরা গাছগুলো কাটার পর ট্রাক ও ট্রলিতে করে নিয়ে যাচ্ছেন। সমিতির সাধারণ সম্পাদক তানজির আহমেদ শাকিব ও তার সাথে থাকা লোকজন তাদের সহায়তা করছেন। সকাল থেকে বিকাল ৩ টার মধ্যে প্রায় ৩’শ গাছ কাটা হয়েছে। বাকি গাছগুলো এখনও রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
সমিতির সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, তানজির আমাদর গাছ বিক্রির কথা বলেছে, আর গাছগুলো নাকি ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন শুনছি ৩২ লাখ টাকার কথা। আমরা এখনও টাকা পাইনি। সে আমাদর সাথে জালিয়াতি করেছে। এর শাস্তি চাই।
কাঠ ঠিকাদার রুহুল আমিন বলেন, সমিতির চুক্তিপত্র ছাড়া আমার নিকট কোনো কাগজপত্র নেই। সবকিছুই ম্যানেজ করছে সমিতির সাধারণ সম্পাদক তানজির। আমি তাঁর নিকট থেকে গাছগুলো ক্রয় করেছি। গাছের দাম নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলন, ১৫ লাখ টাকার একটু বেশী আছে।
আরেক কাঠ ব্যবসায়ী কালাই পৌরশহরের বাসিন্দা সোহেল খন্দকার বলেন, আমি তানজিরের সাথে গাছগুলো নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম। ২৫ লাখ টাকা দামও করেছি। কিন্তু দাম আরও বেশি হবে বলে তিনি আমাকে গাছগুলো দেননি।
সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাছ বিক্রির বিষয় আমি কিছুই জানিনা। গাছের টাকা নিয়ে সদস্যরা আমাকে বিভিন্ন কথা বলছে। মূল্যের ২০ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে ও ১০ শতাংশ অর্থ জমির মালিকদেরও দেয়নি তানজির। আমি এসবের মধ্যে নেই। গাছগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করলে দাম আরো বেশি পাওয়া যেত।
উদয়পুর ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও তেলিহার গ্রামের বাসিন্দা বাদশা মিয়া বলেন, তানজির সমিতির সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে গোপনে রাস্তার গাছগুলো ৩২ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে অথচ সমিতির সদস্যদের নিকট বলেছে ১৫ লাখ টাকার কথা। আমার নিকট সমিতির সদস্যরা অভিযাগ করেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
গাছ কাটার ওয়ার্কঅর্ডার বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক তানজির আহমদ শাকিব বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সমিতির চুক্তিপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। ইউএনও’র মৌখিক নির্দেশে গাছগুলো বিক্রি করেছি। কত টাকায় গাছ বিক্রি করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন বিভাগ মূল্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে ১২ লাখ টাকা আর বিক্রি করেছি ১৫ লাখ টাকায়। গাছ কাটা শেষ হলে সমিতির সদস্যদের মধ্যে বন্টন করা হবে। ৩২ লাখ টাকার অভিযোগ সত্য নয়।
ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টর পর আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছি। গাছ বিক্রির টেন্ডারের বিষয়ে কিছুই জানিনা। তাছাড়া কোনও অর্থও জমা হয়নি পরিষদে।
কালাইয়ের সামাজিক বনায়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ বলেন, গাছের মূল্য নির্ধারণ কম-বেশী হতে পারে কিন্তু সরকারি জায়গার গাছ টেন্ডারের বাহিরে বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই।
কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিমা আক্তার জাহান বলেন, উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় গাছ বিক্রির অনুমোদনের রেজুলেশন থাকলেই যথেষ্ট। এতে টেন্ডার বা কোটেশনের প্রয়াজন নেই। শুধুমাত্র বিক্রি মূল্যের ২০ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদের কোষাগারে জমা থাকলেই হবে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগে গাছ কাটা বন্ধ করা হয়েছে।
জয়পুরহাটের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বলেন, সরকারি জায়গার গাছ বিক্রি করতে হলে অবশ্যই টেন্ডারের মাধ্যমে করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। যদি ইউএনও মৌখিক নির্দেশ দিয়ে থাকেন তারও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।