টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ির আঙিনায় মসজিদ-ঈদগাঁ মাঠ ও মন্দির। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে বাগবিতণ্ডা ছাড়াই চলছে নামাজ ও পূজা। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অমিয় নিদর্শন স্থাপন করেছেন স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও চৌধুরী বাড়িতে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১২টায় জুমআ’র নামাজের আজান শুরু হতেই থেমে গেল ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজ। নামাজ শেষে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পুনরায় শুরু হলো পূজার আচারানুষ্ঠান। দুই ধর্মের লোকজনরাই নিজ-নিজ ধর্মীয় আচার ও নিয়ম পালন করছে দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে। কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
জানা যায়, নাগরপুর চৌধুরী বাড়িতে ৯২ বছর আগে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন শ্রী পরেশ চন্দ্র ও শৈলেশ চন্দ্র দাসয়ো। এরপর থেকে প্রতিবছর ধুমধাম করে দুর্গাপূজা উদযাপন করে এলাকার সনাতনধর্মীর লোকজন। মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পর একই বাড়ির আঙিনার অপরপাশে(পশ্চিমাংশে) নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একই মাঠের পশ্চিমাংশে মসজিদ আর পূর্বাংশে মন্দির নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে কখনও ধর্মীয় কোনো দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়নি। একই সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমরা যার যার ধর্ম পালন করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মন্দিরে পূজা-অর্চনা চলছে, উলুধ্বনি ও ঢাকের বাজনাও আছে। পূজারি ও দর্শনার্থীরা প্রতীমা দেখতে এবং পূজায় অংশ নিতে ভির করছেন। নির্ধারিত সময়ে আজান শুরু হতে হঠাৎই থেমে যাচ্ছে, ঢাক-ঢোল-কাঁসর, মাইক ও উচ্চশব্দের বক্সের বাজনা। আজানের পর মুসল্লিরা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করছেন। নামাজ শেষ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের ঢাক-ঢোল-কাঁসর আর উচ্চশব্দের বাজনা।
বদোবৃদ্ধ লিপি চক্রবর্তী জানান, তারা দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এখানে পূজা করছেন। পাশে মসজিদ ও মন্দির থাকলেও তাদের কোন সমস্যা হয় না। ইসলাম ধর্মের মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। তারাও নামাজ ও আজানের সময় পূজা বন্ধ রাখেন। এটা কাউকে বলে দিতে হয়না। নামাজের আজানের সময় হলে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায় পূজার কর্ম। যুগ যুগ এই সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। সারা বছর এলাকার হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হিসেবে মিলেমিশে বসবাস করেন। ৫৪ বছরের মধ্যে কোনো দিন দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনা তিনি দেখেন নি।
চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল জানান, তিনি জন্মের পর থেকে একই বাড়ির আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির দেখছেন। পূর্বাংশের মন্দিরে সনাতন ধর্মের লোকজন পূজা-অর্চণা করেন। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই একে অপরের পরিপুরক হিসেবে কাজ করেন। কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়- তারা সব সময় এ বিষয়টা লক্ষ্য রাখেন।
ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি লিটন কুমার সাহা পোদ্দার জানান, এই মন্দিরটা বহু বছরের পুরনো। একটি বাড়ির মাঠের(উঠানের) পশ্চিমাংশে মসজিদ ও পূর্বাংশে মন্দির। এ এলাকার হিন্দু-মুসলমানরা যার যার ধর্মীয় আচার পালন করে থাকেন। তারা যেমন মুসলমানদের ঈদে আনন্দ করেন। তেমনি পূজায় মুসলমানরা আনন্দ করেন। মুসলিমরা পূজা-অর্চণায় তাদের সহযোগিতা করেন। এ পর্যন্ত এখানে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তিনি আশা করেন- কখনও ঘটবেও না।
চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা আব্দুল লতিফ মিয়া জানান, মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রায় আড়াই বছর পর থেকে দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে তিনি এই মসজিদের ইমামতি করছেন। এ পর্যন্ত এখানে হিন্দু বা মুসলমানদের সঙ্গে কোনো ঝগড়াঝাটি হতে তিনি দেখেন নাই। আজান-নামাজের সময়সূচি তাদের(হিন্দুদের) কাছে দেওয়া আছে। নামাজ ও আজানের সময় তারা বাদ্য-বাজনা বন্ধ রাখেন। নামাজে যাতে মুসলিমদের কোন অসুবিধা না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখে। তারাও তাদের পূজা-অর্চণায় সার্বিক সহযোগিতা করেন। নামাজ শেষে তারা আবার তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করেন।
নাগরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার(ভারপ্রাপ্ত) দীপ ভৌমিক জানান, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ি। একই বাড়ির উঠানের একাংশে মসজিদ ও অপরাংশে মন্দির। তারা নামাজের সময় নামাজ আদায় করছে আবার পূজার সময় পূজা উদযাপন করছে। বিগত বছরের মতো এ বছরও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।