চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে শিক্ষা অর্জনে বয়স যে কোনো বাধা নয়, তা আবারো প্রমাণ করলেন সেই আব্দুল হান্নান। এবার তিনি এইচএসসিও পাস করে বুঝিয়ে দিলেন, ইচ্ছা থাকলে বয়স যাই হোক না কেন শিক্ষাটা অর্জন করা যায়। আব্দুল হান্নান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের কামাত গ্রামের বাসিন্দা। বয়স এখন ৫৭ বছর।
তিনি এর আগে গ্রামের বেশ কিছু লোকজনের সমালোচনার মধ্যেও ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সফলতার মুখ দেখেন। এ নিয়ে ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠেছিলেন তিনি। এসএসসি পাস করার পর থেমে থাকেননি। প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন এইচএসসিরও।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে কৃতকার্য হওয়ার তথ্য পাবার পর বিষয়টি নিশ্চিত করেন আব্দুল হান্নান। এবার তিনি জিপিএ ৩.২৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগর এম.টি.এম.কে. আনক টি.বি.এম. কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
আব্দুল হান্নান বলেন, শিক্ষার কোনো বয়স হয় না। তাই শিক্ষা গ্রহণে বয়স বাধা হতে পারে না। ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। তিনি আরো বলেন, আমার পরীক্ষার ফলাফলে এলাকায় ব্যাপক উৎসাহ দেখা দিয়েছে। শিক্ষা ছাড়া দেশ ও জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে। তাই সকলের ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
এদিকে আব্দুল হান্নানের এইচএসসি পাসের খবরে আবারো এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। তার আত্মীয়স্বজনরা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সামনে যেন তিনি আরো ভালো কিছু করতে পারেন, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও তাকে ঘিরে আনন্দে উদ্বেলিত।
বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন জানান, আমি নিজেও একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলাম। আমি জানি শিক্ষার মর্যাদা। এ বয়সে আব্দুল হান্নান যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, সেটা অবশ্যই অনুকরণীয়।
এর আগে ২০২১ সালের এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ ৪.১১ পেয়ে উত্তীর্ণ হন আব্দুল হান্নান। পেয়েছিলেন কয়েকটি সংগঠনের বিশেষ সম্মাননাও। মৃত মঞ্জুরের চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে আবদুল হান্নান। কিছুটা বাউন্ডুলে এই মানুষটি ৮ম শ্রেণী পাসের পর পড়াশোনায় ইতি টানেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার দৌড় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত হলেও জমি-জমার হিসাব বুঝতেন ভালোই। সে সুবাদে এলাকার এ-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আদালতে যাতায়াত তার। আদালত ঘুরতে ঘুরতেই ইচ্ছে জাগে মুহুরি হওয়ার, মাকেও বলেন সে কথা। এটি ২০১০-১১ সালের দিককার কথা। কিন্তু বাধ সাধে প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র। মুহুরি হতে হলে এসএসসি পাস সনদ লাগবে।
আবদুল হান্নান ফাঁকি দিয়ে সনদ অর্জন করতে চাননি। চেয়েছিলেন রীতিমতো পরীক্ষায় অংশ নিতে। তার অদম্য ইচ্ছায় তাকে এসএসসি পাস করিয়েছে। ২০১৮ সালে তেলকুপি জামিলা স্মরণী ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন আবদুল হান্নান। ভর্তি হয়ে সব পরীক্ষায় অংশ নেন। নিয়মমাফিক এসএসসি পরীক্ষায় বসেন ২০২০ সালে। কিন্তু দুটি বিষয়ে অকৃতকার্য এবং একটি বিষয়ে অনুপস্থিত থাকায় ২০২১ সালে আবারো এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। এবার আশাহত হননি তিনি। কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ-৪.১১ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
আবদুল হান্নানের ৩ ছেলে, ২ মেয়ে।
নতুন করে পড়ালেখার শুরুটা কীভাবে শুরু হয় তা এসএসসি পাস করার পর প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, জমি-জমা সংক্রান্ত কাজে প্রায়ই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে যেতে হতো। এ থেকেই মুহুরি হিসেবে কাজ করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু এ পেশায় যোগদান করে পরিচয়পত্র পেতে হলে ন্যূনতম এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট লাগে। তাই সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য আমি ২০১৮ সালে তেলকুপি জামিলা স্মরণী ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হই। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হই। আবারো ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিই এবং জিপিএ-৪.১১ পেয়ে পাস করি।
সেই সময় তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথাও বলেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার কথা রেখেছেন। এবার এইচএসসিও পাস করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।এদিকে বুধবার বিকালে পৌর এলাকার কোর্ট বাজার এলাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫৭ বছর বয়সী আবদুল হান্নানকে সংবর্ধনা দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদ।