মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: মিরসরাইয়ে ভয়াবহ বন্যায় ৭০০ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক চাষি। ক্ষতি পুষিয়ে কীভাবে নতুন করে ব্যবসা শুরু করবেন সে চিন্তায় ঘুম হারাম অনেকের। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠা এসব মৎস্য প্রকল্প থেকে বছরে ৫০ হাজার টনের বেশি মাছ উৎপাদন হয়। এসব মৎস্য প্রকল্প থেকে এক হাজার ১২৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করেন চাষিরা। মুহুরীর চর মৎস্য প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৭০-৮০ টনের বেশি মাছ দেশের বিভিন্ন বাজারে যায়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ১৯৮৪ সালে সরকার ফেনী নদীর মিরসরাই-সোনাগাজী অংশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের ফলে ৫০ হাজার একরের বেশি চর জেগে উঠে। এ বাঁধের দক্ষিণে যতদূর চোখ যায় ততোদূর শুধু মৎস্য প্রকল্প। চট্টগ্রাম নোয়াখালী, ফেনী জেলার ৭০ ভাগ মৎস্য চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে এ প্রকল্পের মাছ। এখানে পাঙাশ, কার্প, তেলাপিয়া, গুলশা, পাবদা, শিং, কৈ ইত্যাদি জাতীয় মাছের চাষ হয়। মুহুরী প্রজেক্ট মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত। এখানে এবারের বন্যায় ওই এলাকার ফারুক সওদাগরের ১০ কোটি টাকা, সমমনা সমিতির প্রায় এক কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। শেখ ফরিদের ৪০ কোটি টাকা, শাহ আলমের চার কোটি টাকা, হেলাল উদ্দিন হেলাল সাবের ১০ কোটি টাকা, কামাল ও সাদেকের ৬ কোটি টাকা, মহি উদ্দিন সওদাগরের এক কোটি টাকা, সততা ফার্ম এর দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার ওচমানপুর ইছাখালী ও ধুম এলাকায় প্রায় ১০ হাজার একর প্রকল্পে মাছ চাষ করে আসছেন চাষিরা। এবারের বন্যায় প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে প্রায় ৭ হাজার একর প্রকল্পের মাছ ভেসে গেছে। প্রতি একরে ১০ লাখ টাকা করে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখানে শতাধিক মৎস্য চাষি রয়েছে যারা একেকজন ১০০-৪০০ একর জায়গাজুড়ে মাছ চাষ করে থাকেন।
ফারহা এগ্রোর সত্ত্বাধিকারী মো. কামরুল হোসেন বলেন, গত ২২ বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছি। কখনো এত বড় লোকসানের মুখে পড়তে হয়নি। আমার প্রায় ১০ কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। আমার ভাই কাউছার হোসেনের প্রায় ৭ কোটি, আরেক ভাই জারা এগ্রোর সত্ত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ৫ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। আমাদের পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ২২ কোটি টাকা। এভাবে শত শত মৎস্য চাষি ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
উপজেলার ধুম ইউনিয়নের মৎস্য চাষি আলী হায়দার টিপু বলেন, আমার জীবনের সব সঞ্চয় শেষ। এবারের বন্যায় আমার ৯ কোটি টাকার বেশি মাছ ভেসে গেছে। পানি কমে যাওয়ার পর প্রকল্পে গিয়ে দুচোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সব প্রকল্পের পাড় ভেঙে গেছে। এখন কীভাবে প্রকল্পের মেরামত করবো, কীভাবে নতুন করে ব্যবসা শুরু করবো বুঝতে পারছি না।
একই এলাকার আরেক চাষি জহির উদ্দিন ইরান বলেন, নিজের ব্যক্তিগত পার্টনারে প্রায় ২০০ একর জায়গায় মাছ চাষ রয়েছে। কোনোদিন এমন পানি দেখিনি। এতো বেশি পানির স্রোত ছিল পাড় ভেঙে সব নিয়ে গেছে। আমার প্রায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আজমপুর এলাকার মাছ চাষি কামাল উদ্দিন বলেন, এবারের বন্যায় আমাদের মেরে ফেলেছে। আমরা শেষ, সব পুঁজি পানিতে ভেসে গেছে। এখন প্রকল্পের পাড় মেরামত, নতুন করে চাষ করার ওই অবস্থাও নেই।
আরেক চাষি তৌহিদুল তুহিন বলেন, মিরসরাইয়ে আমার ২৫ একর ও সোনাগাজী অংশে ১০ একরের মৎস্য খামারসহ শ্রমিকদের বাসস্থান ও খাদ্য রাখার ঘর, নলকূপ সব মুহুরী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। আমার মত আরও শত শত মৎস্য চাষি রয়েছেন। অনেকের ব্যাংক লোন রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে মাছের খাদ্য ও ওষুধের দোকানের বকেয়া। এসব ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
মুহুরী প্রজেক্ট মৎস্য চাষি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মৎস্য জোন প্রতিষ্ঠান হওয়ার পর থেকে এমন ভয়াল বিপর্যয়ে পড়েনি মৎস্য চাষিরা। এবারের বন্যায় অনেক চাষি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। আমরা চাষিদের পক্ষ থেকে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জমা দিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা না পেলে এ শিল্পে অনেকের টিতে খাকতে কষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নের বিনিয়োগ তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হয়ে গেছে। এ বন্যায় মৎস্য চাষিদের প্রায় প্রতি একরে ১০ লাখ করে ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, মিরসরাইয়ে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মৎস্য খাতে আমাদের প্রাপ্ত তথ্যে প্রায় ৩৭৪ কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য চাষিদের দাবি ক্ষতির অংকটা ৭০০ কোটি টাকা। তবে আমরা এখনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি।