মাসুদুর রহমান খান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের পশ্চিম দিঘলী গ্রাম হয়ে পূর্ব দিকে যে বেড়িবাঁধটি গেছে, সেটি এ বন্যায় আশপাশের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে। বন্যার পানি হু হু করে যখন ঘরে ঢুকতে শুরু করে, তখন বেড়িবাঁধের দুই পাড়ের বাসিন্দারা নিজেদের এবং গৃহপালিত পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখা শুরু করেন। তখনই তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে উঠে পড়েন পাশের বেড়িবাঁধের ওপর।
ওই বেড়িবাঁধের ওপর অস্থায়ী ছাউনি বা ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে দুই শতাধিক পরিবার এখনো বসবাস করছে। কোনো কোনো পরিবার দুই সপ্তাহ কিংবা তারও বেশিদিন ধরে অবস্থান নিয়েছে বাঁধটির ওপর। তারা এখন প্রহর গুনছে, কখন বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি নামবে।
দেখা গেছে, বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে নিম্ন আয়ের ভূমিহীন পরিবারদের স্থায়ী বসবাস ছিল। আবার বাঁধের দুইপাশেই হাজার হাজার মানুষের বসতবাড়ি। বেড়িবাঁধের উত্তর অংশে কিছুটা অদূরেই ওয়াপদা খাল। যেটি লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ এলাকার থেকে উৎপত্তি হয়ে জেলার পূর্বদিক থেকে এসে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়েছে। এবারের বন্যার পানি নোয়াখালী অঞ্চল থেকে ওয়াপদা খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে প্রবেশ করে খালপাড়ের লোকালয়গুলো ডুবিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের উত্তর অংশ। বন্যার পানি নামা শুরু করলেও দিঘলীর কোনো কোনো এলাকার পানি এখনো বুক পরিমাণ দেখা গেছে। ওইসব এলাকার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাঁধের ওপর।
রোকসানা বেগমের ঘরটি বেড়িবাঁধের দক্ষিণ কিনারায়। ঘরে এখনও পানি। তিনি বেড়িবাঁধের ওপর অস্থায়ী একটি ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে সেখানে পরিবারের লোকজন নিয়ে বসবাস করছেন গত তিন সপ্তাহ ধরে। পুরোনো বসতঘরের চিত্র দেখিয়ে এ নারী বলেন, ঘরের ভেতর এখনও পানি। তিন সপ্তাহ আগে বন্যার পানি উঠেছে। কিন্তু এখনও নামেনি। হুট করে বন্যার পানি যখন উঠেছে, তখন সামান্য কিছু মালামাল সরাতে পেরেছি। অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছি। আশ্রয় নেওয়া নারী জোহরা বেগম বলেন, বন্যার পানি খুব দ্রুত আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। খাটের কাছাকাছি পর্যন্ত পানি উঠে পড়ে। খাটের ওপর যখন উঠে পড়েছে, তখন তো আর ঘরে থাকার সুযোগ নেই। তাই গভীর রাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল কাঁথা-বালিশ যা যা কিছু ছিল সব নিয়ে বাড়ির পাশে থাকা বেড়িবাঁধের ওপর উঠে আসি। ঘরের কিছু মালামাল টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছি। ঘরে এখনও খাট সমান পানি।
নুর নাহার নামে আরেক নারী বলেন, বেড়িবাঁধের পাশে থাকতাম। বন্যার পানি ঘরে উঠতে উঠতে খাটের ওপর আরও প্রায় এক ফুট পানি উঠে গেছে। তখন বাঁধের ওপর উঠে আসি। এখন বাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘরে থাকি। ঘরের অনেক কিছু পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো নিরাপদে নিয়ে আসতে পারিনি। বাঁধের ওপর আশ্রয় নেওয়া নুর হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে ঘরের মধ্যে পানি। বাঁধের ওপর ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। এখনও ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি। কবে ঘরে ফিরতে পারবো সে নিশ্চয়তা নেই।
জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক কৃষক বলেন, এক মাসের মতো আমরা বন্যাকবলিত। এখনও ঘরের ভেতর পানি। পরিবারের লোকজন নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছি। কবে ঘরে বসবাস শুরু করতে পারবো, তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। ঘরের অবস্থা একেবারে জরাজীর্ণ।তিনি জানান, আমাদের মতো অন্তত দুইশ পরিবার এ বাঁধে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে থাকতেছে। আমরা ঘরবাড়ি রেখে বাঁধের ওপর উঠলেও আশ্রয় কেন্দ্রে যাইনি। আমাদের অনেকের গরু ছাগল, হাঁস-মুরগি আছে। এগুলো রেখে কোথায় যাব? বাড়িঘরও দেখাশোনা করা লাগে। তাই বাড়ির পাশের বেড়িবাঁধই আমাদের আশ্রয়স্থল।
তিনি আরও জানান, দুই শতাধিক পরিবারে হাজারের বেশি নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের ওপর। তিন শতাধিক গরু আছে বাঁধের ওপর। অনেকের খড়ের গাদা বন্যার পানিতে পচে যাওয়ায় গো-খাদ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে গৃহস্থরা। মোমিন উল্যা নামে এক বৃদ্ধ বলেন, বেড়িবাঁধের একটু দূরে আমার বাড়ি। ঘরে হাঁটু পানি ছিল। এখন ঘর থেকে পানি নেমেছে। তবে ঘরের অবস্থা একেবারে খারাপ। আমার বৃদ্ধ স্ত্রী বেড়িবাঁধের ওপর থাকতে চায় না। তাই ঘরে নিয়ে এসেছি। কিন্তু ঘরের সামনে হাঁটু পানি। বাড়ির রাস্তায় বুক পরিমাণ পানি। গরুগুলোকে বাঁধের ওপর রেখে আসছি। বাড়ি থেকে বেড়িবাঁধে আসা-যাওয়া অনেক কষ্ট হচ্ছে।