‘খালটি ছিল ডাকাতিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ব্যবসায়িক কেন্দ্র চৌমুহনীতে একসময় এ খাল দিয়ে চাঁদপুর থেকে নৌকা-ট্রলারে মালামাল আনা-নেওয়া হতো। খালে জোয়ার থাকতো। এখন পানি চলাচলের ব্যবস্থাই নেই। দীর্ঘদিন ধরে খালটি ভরাট হয়ে পানি চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। বাজারের অংশে কচুরিপানা, ময়লার ভাগাড়। খালের পানি নড়ে না।’
নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলায় ডাকাতিয়া খালের ওপর দাঁড়িয়ে একথা বলেন সোনাইমুড়ী বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন সেলিম।
তিনি বলেন, ‘বন্যায় এ বাজারে পানি উঠেছে। অথচ বাজারের মাঝখানে খাল। তবুও পানি নামেনি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় একবার খালটির সীমানার ভিতরে যত অবৈধ দোকান ছিল সব ভেঙে দিয়েছিল। পরে ঘুস দিয়ে মালিকরা আবার দোকান বানায়। এরপর খালও আর খনন করেনি। খালটি অন্তত পরিষ্কার থাকলে পানি নেমে যেত দ্রুত।’
জানা যায়, নোয়াখালী জেলার এ খালটি সরাসরি ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গে যুক্ত। তাই খালটিকে স্থানীয়দের কেউ ডাকাতিয়া খাল বলেন। চৌমুহনী-সোনাইমুড়ী খাল হিসেবেও পরিচিত। এটি পূর্বদিকে জেলার বেগমগঞ্জে নোয়খালী খালের সঙ্গে যুক্ত। পশ্চিমে সোনাইমুড়ী থেকে নদনা হয়ে বাঁক নিয়ে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায় গেছে। আবার সোনাইমুড়ী থেকে চাটখিল উপজেলা হয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরে গিয়ে পড়েছে ডাকাতিয়া নদীতে।
সরেজমিনে সোনাইমুড়ী উপজেলার এ খালটির বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা যায়, খালের ওপর অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বাজারের প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে খালটি প্রায় মৃত। খালে গজিয়েছে কচু গাছ। বাজার এলাকায় তিনটি সংযোগ পোলের নিচেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এছাড়াও খালের উত্তর পাশে প্রায় ২০টি দোকানের সীমানা খালের ভিতরে। কোনো দোকান দুই ফুট কোনো দোকান চার ফুট খালের ভিতরে দেখা গেছে। এছাড়াও সোনাইমুড়ী পৌরসভার সব ময়লা এ খালে এসে পড়ে বলে জানান স্থানীয়রা।
সোনাইমুড়ী বাজারের সীমানা শেষে পাশের উপজেলা চাটখিল থেকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় খালের বাঁকে বাঁকে অপরিকল্পিত কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বাজার এলাকায় খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে দোকান।
ব্রিজ যখন করা হয়, তখন নিচ থেকে ওঠানো মাটি-পাথর না সরানোর কারণে উঁচু হয়ে পানি নামছে না। যার কারণে খাল দিয়ে ভালোভাবে পানি যাচ্ছে না। সরকার চাইলেই খালটি পরিষ্কার করতে পারে। এখান দিয়ে পানি নামলে লোকালয় থেকে পানি নামতো।- সোনাইমুড়ীর স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফুর রহমান
জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা থেকে আসা কাঁকড়ি নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের উজিরপুর ইউনিয়নের কাশিপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ডাকাতিয়া নদী। এরপর লাকসাম-মনোহরগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে মিশেছে এটি। নদীটির দৈর্ঘ্য ২০৭ কিলোমিটার। এর শাখা মিলেছে নোয়াখালী খালের সঙ্গে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক আশরাফুল আমিন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখছি খালটা ক্রমে ছোট হচ্ছে। খাল দখল করেই দুই পাশে কিন্তু দোকান। গত কয়েক বছরে এমনভাবে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে খালের ওপর দিয়ে হেঁটে একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়া যাবে। ক্ষমতার প্রভাবে এ খাল নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘সোনাইমুড়ী ও বেগমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় গত একমাস মানুষ পানিবন্দি। অথচ খাল শুকনো, পানির কোনো প্রবাহ নেই। গত ১৫ বছরে খালটা খনন কিংবা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়নি। যত জায়গায় বাজার আছে সবখানে দূষণ।’
সোনাইমুড়ীর স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলায় এ খালে জোয়ার দেখেছি। নিয়মিত স্রোত থাকতো। এখন সেসব দেখা যায় না। খালের ব্রিজগুলোর নিচেই বাঁধ আছে। ব্রিজ যখন করা হয়, তখন নিচ থেকে ওঠানো মাটি-পাথর না সরানোর কারণে উঁচু হয়ে পানি নামছে না। যার কারণে খাল দিয়ে ভালোভাবে পানি যাচ্ছে না। সরকার চাইলেই খালটি পরিষ্কার করতে পারে। এখান দিয়ে পানি নামলে লোকালয় থেকে পানি নামতো।’
বাজারের ধানসিড়ি হোটেলের ম্যানেজার মফিজউল্লাহ বলেন, ‘বাজারের সব ময়লা এখানে আসে। পৌরসভার সরকারি গাড়ি দিয়েও এখানে এসে ময়লা ফেলে। আমরাও ময়লা ফেলি, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু গতবছর বেগমগঞ্জ থেকে সোনাইমুড়ীর কালভার্ট পর্যন্ত কাটছে, বাজারের এদিকে তারা আর কাটেনি। শুনেছি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাল কাটা বন্ধ করেছে।’
নোয়াখালীতে এখন জলাবদ্ধতার কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। সমস্যা হলো পানি নামছে না। বেগমগঞ্জ-চাটখিলের পানিটা মূলত ওয়াপদা খাল হয়ে চন্দ্রগঞ্জ হয়ে লক্ষ্মীপুরের মেঘনাতে গিয়ে পড়ে। আমাদের নোয়াখালী অংশে খালটার পানি প্রবাহ ভালো আছে। কিন্তু লক্ষ্মীপুর অংশ দিয়ে পানি নামছে না।- নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল
বাজারের আলী টাওয়ার মার্কেটের দুটি রুম খালের প্রায় চার ফুট জায়গা দখল করে করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এ বিষয়ে আলী টাওয়ারের ম্যানেজার শাহজাহান বলেন, ‘আমাদের ভবন গাইডওয়ালের ভিতরে। যখন ভবন করা হয়েছে তখন তৎকালীন এসিল্যান্ড ছিলেন। মেপে করা হয়েছে। এখন সন্দেহ হলে মেপে দেখুক।’
নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল বলেন, ‘৩২৪ কোটি টাকার যে প্রকল্পের কাজ ছিল, সেসময় আমি ছিলাম না। ওই সময় ১৮২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে ব্লকবাঁধ নির্মাণে। বিভিন্ন জায়গায় খালও খনন হয়েছে, কোথায় হয়নি সেটি আমি বলতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘নোয়াখালীতে এখন জলাবদ্ধতার কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। সমস্যা হলো পানি নামছে না। বেগমগঞ্জ-চাটখিলের পানিটা মূলত ওয়াপদা খাল হয়ে চন্দ্রগঞ্জ হয়ে লক্ষ্মীপুরের মেঘনাতে গিয়ে পড়ে। আমাদের নোয়াখালী অংশে খালটার পানি প্রবাহ ভালো আছে। কিন্তু লক্ষ্মীপুর অংশ দিয়ে পানি নামছে না। এছাড়া শাখা-প্রশাখা সব খাল দিয়ে যায়।’
‘সবচেয়ে বড় সমস্যা, যত জায়গায় বাজার আছে প্রতিটা বাজারের পাশে খালগুলো ময়লার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করছে। ময়লা ফেলতে ফেলতে এখন পানি যাচ্ছে না কোথাও। খালের মালিকানা হচ্ছে জেলা প্রশাসনের। আমরা অবৈধ দখল দেখি না। আমরা শুধু খাল খননের বিষয়টা দেখি। খননে দখল উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসনের সহায়তা প্রয়োজন হয়।’ বলেন তিনি।
জানা যায়, নোয়াখালীর চাটখিল, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও সেনবাগ উপজেলার দুই লাখ ২৬ হাজার পরিবারের সাড়ে ১১ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। এসব এলাকায় ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো সাড়ে ৩৫ হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তাঘাট। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর জমির ফসল। চৌমুহনী বড় পুল এলাকাটি তিনটি খালের সংযোগস্থলে অবস্থিত।