পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ৪ জন নিহত, অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবিতে শুক্রবার ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দেয় ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতা’। শনিবার সকাল ৬টা থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ চলছে। ৭২ ঘণ্টার এই অবরোধের শুরুতেই তিন জেলায় দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলছে না। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে রাঙামাটিতে আজ সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে মালিক সমিতি। রাঙামাটিতে বাস, ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এই ধর্মঘট ডেকেছেন তাঁরা। গতকাল রাতে এক জরুরি সভায় তাঁরা এ ঘোষণা দেন।
অবরোধে সকাল থেকে খাগড়াছড়ির সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকার যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম যাত্রাপথে চলাচলকারী শান্তি পরিবহনের বাস চলছে না। একই রুটে চলাচলরত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) বাসও সকালে কোনো প্রান্ত থেকে ছাড়েনি। আন্ত–উপজেলায় চলাচলকারী জিপ বা সিএনজিচালিত অটোরিকশাও চলছে না।
জিপ মালিক সমিতির সভাপতি নির্নিমেষ দেওয়ান বলেন, ‘কোনো গাড়ি আজ থেকে চলবে না। বিভিন্ন উপজেলা এবং সাজেকে চলাচল করে আমাদের গাড়িগুলো। অবরোধের জন্য তা বন্ধ রয়েছে।’
একইভাবে রাঙামাটি ও বান্দরবানের সঙ্গেও চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। রাঙামাটিতে চলাচলকারী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও বান্দরবানের পূরবী ও পূর্বাণী বাস চলছে না। এ ছাড়া ঢাকায় চলাচলকারী বাসও ছাড়েনি। তিন জেলার সঙ্গে পণ্য পরিবহনের ট্রাক ও পিকআপ গাড়ি চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
গত বুধবার খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালি সংঘাতের রেশ পার্শ্ববর্তী জেলা রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ-সহিংসতায় পার্বত্য এই দুই জেলায় ৪ জন নিহত এবং অন্তত ৮০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গতকাল দুই জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবারের সংঘাত, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনার পর থেকে পাহাড়ে বসবাসকারী পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায় আতঙ্কের মধ্যে পড়েছে। দুই জেলায় সেনা, পুলিশ ও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে হত্যার প্রতিবাদে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বাঙালিদের অভিযোগ, মিছিলটি বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সংঘর্ষের একপর্যায়ে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে বিভিন্ন দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে।
দীঘিনালা উপজেলায় সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
খাগড়াছড়িতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকালে রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন পাহাড়িরা। মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ ৩০ থেকে ৪০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সংঘর্ষে একজন নিহত এবং আহত হয়েছেন দুই পক্ষের অন্তত ৫৫ জন। নিহত ব্যক্তির নাম অনিক কুমার চাকমা। তিনি কর্ণফুলী ডিগ্রি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।
আজ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলের দুই জেলা পরিদর্শন করার কথা রয়েছে।