মাসুদুর রহমান খান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি: সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ও নানাবিধ সমস্যার বেড়াজালে বন্দী লক্ষ্মীপুরের বিসিক শিল্পনগরী। অথচ অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ সুবিধার অভাবে এই শিল্পনগরীতে এখনও গড়ে ওঠেনি উল্লেখযোগ্য শিল্প কারখানা। হাতেগোনা যে কয়টি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, তাও গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও ড্রেনেজ সমস্যাসহ অভ্যান্তরীণ সড়কের বেহাল দশার কারণে বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে এই শিল্পনগরীতে শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহ হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
নারিকেল, সুপারি আর সয়াবিনের রাজধানী হিসাবে খ্যাত লক্ষ্মীপুরে ১৯৯৭ সালে পৌর শহরের বাঞ্চানগর এলাকায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬ একর ভূমির ওপর গড়ে তোলা হয় লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরী। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে দীর্ঘ ২৪ বছরেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন-বিসিক। শুরুতে এ শিল্পনগরীতে তৈরি করা হয় তিন ক্যাটাগরির ১০০টি প্লট। আর এসব প্লট ৫৪টি শিল্প ইউনিটের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পনগরীটিতে ৪৩টি শিল্প ইউনিট তাদের কার্যক্রম শুরু করলেও নানাবিধ সমস্যায় এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ২৫টি ইউনিট। বর্তমানে শিল্প নগরীটিতে বেকারি, অটো রাইস মিল, ভাইয়া গ্রুপের শিল্প প্রতিষ্ঠান নেক্সস ফুড ও মবিল রি-প্যাকিং ফ্যাক্টরিসহ কয়েকটি শিল্প কারখানা চলমান থাকলেও, অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নানা কারণে এই শিল্প ইউনিটগুলোও রয়েছে হুমকির মুখে। এমন বাস্তবতায় এই শিল্পনগরীতে শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহ হারাচ্ছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বিসিকের অভ্যান্তরীণ রাস্তাগুলো সংস্কার না করায় পুরো রাস্তাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। এছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এতে পণ্য আনা-নেয়াসহ চলাচলে অসুবিধায় পড়তে হয় তাদের। ফলে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তাদের অভিযোগ, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বাতি ও সীমানা প্রাচীর না থাকায় শিল্পনগরীতে বাড়ছে মাদকসেবীদের আড্ডা। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। এতে করে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়ায় হাটা-চলায়ও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
বিসিক শিল্প নগরীর সুলতানিয়া বেকারীর মালিক মো. আবুল কাসেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কারখানা নির্মাণকালে ব্যাংক ঋণ জরুরি হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। টাকার অভাবে কারখানা করা না গেলে চালু হবে কীভাবে? তিনি অভিযোগ করে বলেন, শিল্প এলাকায় তাদের শিল্পের আওতায় গ্যাস সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও সংশ্লিষ্টরা তাদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক হারে টাকা আদায় করছেন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিল্প মালিকরা।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরী শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমএ রহিম ভুঁইয়া জানান, শিল্পনগরীতে রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা একেবারেরই অকেজো হয়ে পড়েছে। এই শুষ্ক মৌসুমেই সড়কটি যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এছাড়া গ্যাস সমস্যার কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
শিল্পনগরীর মধুমিতা বেকারীর মালিক মো. সেলিম বলেন, অনেক আশা করে আমরা শিল্পনগরীতে শিল্প স্থাপন করেছি, কিন্তু কোন সুযোগ সুবিধাই পাচ্ছি না। তাছাড়া গ্যাস, পানি ও ড্রেনেজ সমস্যার কারণে প্রতিনিয়তই সমস্যায় পড়তে হয়।’ এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায়, অব্যাহত লোকসানের মুখে পড়ছেন তারা। এইভাবে চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলেও জানান তিনি।
এদিকে, শিল্প উদ্যোক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতি বছর বিসিক কর্তৃপক্ষ শিল্পকারখানা থেকে সর্বনিম্ন সাড়ে ৬ হাজার টাকা করে সার্ভিস চার্জ নিলেও, সেই তুলনায় তারা কোন ধরনের সার্ভিস পাচ্ছেন না। এছাড়া, শিল্পনগরীতে স্থাপিত বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বাতির ব্যবস্থা না থাকায় কারখানাগুলোতে অহরহ ঘটছে চুরির ঘটনাও। কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো দেখেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।
অন্যদিকে, উদ্যোক্তাদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরীর উপব্যবস্থাপক মো.আসাদুল্লা হাসান। তিনি বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সমস্যার কারণে অধিকাংশ প্লটেই শিল্প উদ্যোক্তারা শিল্প কারখানা স্থাপন করতে পারছেন না। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি ও ড্রেনেজ সমস্য সমাধানের জন্য আর্থিক বরাদ্দ চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ না পাওয়ায় সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছেনা। তবে অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ বিসিক কর্মকর্তা।
বর্তমানে এই শিল্পনগরীতে ১৮টি শিল্প ইউনিট চলমান রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহজ শর্তে শিল্পভিত্তিক ঋণ দেয়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও ড্রেনেজ সমস্যার সমাধান হলে কোন প্লটই খালি থাকবে না। বরং নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠবেন অনেকেই।