যশোর প্রতিনিধি: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বন্ধুত্বে উপকারিতার পাশাপাশি রয়েছে হাজারও অপকারিতা। যাকে কখনো দেখেননি সেও হঠাৎ কাছের বন্ধু বনে যায়। একটা সময় আপনার গোপন কথাও জেনে যায় সে। অনেক সময় ওই বন্ধুই আপনাকে মানসিকভাবে বিপদে ফেলতে পারে। ছবি কিংবা ভিডিওর মাধ্যমেও আপনাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে।
দেশ ছেড়ে প্রবাসে অবস্থানরত প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলা খুবই সহজ। সহজ সরল প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলে অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ইমোতে চলে অন্তরঙ্গ ভিডিও চ্যাট ও কথাবার্তা। অনেক সময় প্রবাসীরা টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়। ভিডিও চ্যাটের স্ক্রিনশর্ট ও ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করার ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ রকম ফাঁদে পড়ে তাদের টাকা দিতে বাধ্য হয় সহজ সরল প্রবাসীরা।
ইদানিং প্রতারকদের প্রধান টার্গেট প্রবাসীরা। এই চক্র সংঘবদ্ধভাবে প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসী নামে বিভিন্ন ফেসবুক টেলিগ্রাম, পেজ, গ্রুপ খুলে প্রবাসীদের অ্যাড করে। সেসব পেজ কিংবা গ্রুপে কিছু মেয়েকে লাইভে আসার জন্য ঘণ্টা চুক্তি করে।
এমন এক প্রতারক প্রমি, দেখতে সুন্দরি ও স্মার্ট। সুন্দরী ও স্মার্ট হওয়ায় এটাই প্রতারণার বড় হাতিয়ার বানিয়েছেন প্রমি। এ সুন্দরকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে প্রেম, বিয়ে ও টাকা দাবী তার নিত্যদিনের সঙ্গী। যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর কারিগর পাড়া গ্রামের হোসনেয়ারা হোসাইন প্রমির কথা। গড়ে তুলেছেন অনলাইনে বড় একটি প্রতারণার সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক ঘণ্টা লাইভে থাকার জন্য ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রুপ চ্যাটিং চালাতে মেয়েদের ভাড়া নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে তারা গ্রুপ লাইভ করে। পাশাপাশি চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ফোন নম্বর সংগ্রহ করে। তাদের প্রধান টার্গেট প্রবাসী বাংলাদেশি।
এছাড়া অনেক সময় অনলাইনেও অফার দেয়া হয়। এক ঘণ্টা ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ চ্যাট করলে বিনিময়ে ২ হাজার টাকা দেয়া হবে। প্রবাসীরা একাকী জীবনযাপন করে নিঃসঙ্গতা দূর করতে এসব ফাঁদে পা দেয় তারা।
প্রতারণার শিকার হয় বিশেষ করে যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যে। প্রতারকরা এতই স্মার্ট যে, তারা সহজ সরল অভিবাসী ও স্থানীয়দের টার্গেট করে তাদের প্রতারণা চালিয়ে যায়। এ প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন অভিযান চালায়। তারপরও এ প্রতারণা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এছাড়া অনেকেই প্রতারিত হন কিন্তু আত্মমর্যাদার ভয়ে কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না। এমনকি থানায় অভিযোগ পর্যন্তও করেন না।
ভুক্তভোগী ফ্রান্স প্রবাসী রাহাত জানায়, প্রমীর সাথে আমার অনলাইনে পরিচয় হয়। পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমরা দুজনে অনলাইনে দীর্ঘ সময় কথা বলতে থাকি। টেলিগ্রামের মাধ্যমে অন্তরঙ্গ অনেক সময় কাটাই। প্রমী গোপনে আমাদের সে ভিডিওগুলো ধারণ করে যেটা আমি জানতাম না। এরপর আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রমী আমার ভিডিও গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আমার কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওর পেছনে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখি তার ফোনে কল যায় না; ফেসবুকে আমাকে ব্লক করেছে।
এমনি কাজ করেছে দুবাই প্রবাসী লিটন, রমজান ও ফিরোজসহ একাধিক প্রবাসীর সাথে। যার একাধিক ভিডিও পত্রিকার দপ্তরে সংরক্ষিত রয়েছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক প্রমির এক আত্মীয় জানায়, প্রমির চরিত্র ভালো না ও খারাপ প্রকৃতির মেয়ে। প্রমি বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত এ কারণে আমরা তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখিনি। তার অপকর্মের কারণে নিজেদের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া থাকে। প্রমির খারাপ কাজের সাথে তার মা-বাবা জড়িত বলেও তিনি জানান।
এ বিষয়ে প্রমি ও তার পরিবারের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কোতয়ালী থানার অফিসাস ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক জানায়, অভিযোগ পেলে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন আগে প্রমি প্রেমের জালে আটকে ফেলেছিল ইউসুফ আলী নামের এক যুবককে। এরপর যশোর ডি-আই জি রোডের একটি বাড়িতে ইউসুফকে দেখা করতে আসতে বলে। প্রমির সাথে দেখা করতে এসে ফেঁসে যায় ইউসুফ আলী। ইউসুফ আলীকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করে প্রমি ও তার সহযোগীরা। প্রমির এই প্রতারণার চক্রের সাথে জড়িত ছিল আরো বেশ কয়েকজন। সম্মিলিতভাবে তারা এই প্রতারণার কাজ চালাতো।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, তার সঙ্গে জড়িত ছিল মাদক সেবনকারী কয়েকজন যুবক। বস্তুত প্রমি নিজেও মাদকাসক্ত। প্রমি ও তার সহযোগীরা জালে আটকে পড়া ইউসুফ আলীর কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং অমানবিক ভাবে নির্যাতন করে। একপর্যায়ে ইউসুফ আলীর কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় প্রমি ও তার সহযোগীরা। এরপর প্রমির প্রেমে জালে আটকে পড়া ইউসুফ আলীকে ছেড়ে দেন। অতঃপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়। এক পর্যায়ে যশোরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নজরে আসে এবং প্রমি ও তার এক যুবক বন্ধুকে গ্রেফতার করেন যশোর কোতয়ালী থানা পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকায় প্রতারণার খবর প্রচারিত হয়।