নুরুল আলম সাঈদ, নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি: বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৫ ইউনিয়নে পাহাড়ী উঁচু-নিচু টিলার পাদদেশে ঝুকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে অর্ধ লক্ষাধিক পরিবার। গত কয়েক বছর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানি ঘটায় বর্তমানে এসব পাহাড়ী টিলায় বসবাসকারীরা চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ী উঁচু-নিচু টিলায় শত শত পরিবার ঝুকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করে আসলেও প্রশাসন তাদের দমিয়ে রাখতে পারছেনা। বর্ষা মৌসুমে মাইকিং করে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাহাড়ী পাদদেশে বসবাসকারীদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হলেও অসহায় দরিদ্র মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাধ্য হয়েই ঝুকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করে যাচ্ছে।
এ নিয়ে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা দেখা দেয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা জুড়ে। উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিঁপূর্ণ স্থানে বসবাস করছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে বড় বড় পাহাড় টিলা কেটে বসত ঘর তৈরী এবং পাহাড় কাটা মহোৎসবের কারণে প্রত্যেক বছরই পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। এতে গত কয়েক বছর ধরে এই উপজেলায় পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানির একাধিক ঘটনা ঘটছে।
সূত্র মতে, উপজেলার সদর ইউনিয়নের স্কুল পাড়া, পর্যটন উপবন এলাকা যৌথ খামার জারুলিয়াছড়ি, লেমুছড়ি, বাগানঘোনা, আদর্শগ্রাম, নারিচবুনিয়া, রেজু বড়ইতলী, চেরারমাঠ, আলিক্ষ্যং, ম্রুরং পাড়া, চাকঢালা, বিছামারা,জুমখোলা, বাইশ ফাড়ী, ফুলতলী, আমতলী, বাহির মাঠ এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিপূর্ণ বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ। এছাড়াও সীমান্তের প্রত্যন্ত উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় অসহায় দরিদ্র মানুষ বসবাস করছে পাহাড়ের পাদদেশে। মাথা গুজানোর মত বিকল্প কোন জায়গা না থাকায় এসব অসহায় দরিদ্র মানুষ প্রাণহানির আশংঙ্কা আছে জেনেও পাহাড়ী চূড়া থেকে সরে যাচ্ছে না। বর্ষা মৌসুম এলে তাদেরকে আতংকের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু কখনো কেউ তাদেরকে কার্যত সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। পাহাড়ে অত্যান্ত ঝুকির মধ্যে বসবাসরতদের বিষয়ে উপজেলা পরিষদে সঠিক কোন পরিসংখ্যানও নেই। বর্ষা মৌসুমের শুরতে জেলা প্রশাসনের চাপের মুখে উপজেলা প্রশাসন মাইকিংয়ের মাধ্যমে সরিয়ে যেতে বললেও কার্যত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না ঝুকিপূর্ণে থাকা মানুষগুলোর জন্য।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো: আলম জানান, তার ইউনিয়নে মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ পাহাড় না থাকলেও কয়েকটি গ্রামের মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে এসব গ্রামের মানুষকে শর্তকাবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। তবে, পাহাড়ে বসবসকারী অধিকাংশরাই অসহায় দরিদ্র মানুষ। তাদের একমাত্র সম্বল শুধুমাত্র একটি পাহাড়, তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব অসহায় মানুষ যাতে বিকল্প ব্যবস্থায় থাকতে পারে সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়ী পাদদেশে যারা বসবাস করছে তাদের মধ্যে অনেকে জায়গার প্রশ্রস্ততা বৃদ্ধি, আবার কেউ জমির মূল্য বৃদ্ধির কারণ পাহাড়ের অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে এসব পাহাড় ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বিচারে এভাবে পাহাড় কর্তনের কারণে পাহাড় ধ্বস হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। নাইক্ষ্যংছড়ির স্কুল পাড়ার স্কুল শিক্ষক রফিক উদ্দিন জানান, ঝুকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে যারা বসবাস করছে তারা নিম্ন আয়ের মানুষ। জীবনের ঝুকি আছে, তা জানার পরও তারা সেখানে বসবাস করে। তবে সরকারিভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে অন্যত্র সরিয়ে নিতে প্রশাসনের প্রতি দাবি করেন তিনি।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বলেন, সরকারের উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা ও ভবন নিমার্ণ করতে গিয়ে পাহাড় কাটঁতে হয়, পরবর্তীতে পাহাড় কাটার অংশ থেকে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধ্বস হয়। সোনাইছড়ি ও দৌছড়ির চেয়ারম্যান যথাক্রমে এ্যানিং মার্মা ও মো: ইমরান বলেন, পাহাড়ী জনপদ ও নতুন নতুন রাস্তা এবং ভবণ নিমার্ণের ফলে, আমার ইউনিয়নে পাহাড় ভেঙ্গে মানুষ জন হতাহত হচ্ছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইসমাত জাহান ইতু বলেন, জনসাধারণ একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই পাহাড় ধ্বস থেকে রক্ষা পেতে পারে। তারপরও পাহাড়ী ঢলে প্রাণহানির ঘটনা যাতে না ঘটে, এজন্য বর্ষা শুরুর আগেই প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে প্রশাসনের মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে থাকতে বলা হয়।
জানা যায়, গত ২৯ জুন নাইক্ষ্যংছড়িতে পাহাড় ধসে আবু বক্কর সিদ্দিক (৫৫) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। সদর ইউনিয়নের ফুলতলী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, ওই দিন সকালে আবু বক্কর বাড়ির পাশের পাহাড়ি ছড়ায় কাজ করতে যান। এ সময় হঠাৎ পাহাড়ের মাটি তাকে চাপা দিলে, তিনি ঘটনাস্থলই মারা যান। পাহাড়ের পাদদেশের ঝিরির পাড়ের জমির নালা থেকে মাটি সরানোর সময় পাহাড় ধসে তিনি চাপা পড়েছেন বলে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান। নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার জানিয়েছেন, বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জমির সেচের নালা বন্ধ হয়ে যায়। ওই নালার মাটি সরানোর সময় পাহাড় ধসে পড়ে আবু বক্কর চাপা পড়েন। ফুলতলী এলাকাটি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন।
গত ১০ জুন নাইক্ষ্যংছড়িতে ঢালু থেকে পাহাড় ধসে গৃহবধুর মৃত্যু হয়। তার নাম আরেফা বেগম (২৮)। সে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চাকঢালা বড় ছড়া গ্রামের আসরত আলীর মেয়ে। জানা যায়, আরোফা বেগম প্রতিদিনের ন্যায় বাড়ির পাশে পাহাড় কাটা টিলার পাশে বসে ছিলো বাড়ির কাজ নিয়ে। হঠাৎ এক পর্যায়ে পূর্বের কাটা ওই পাহাড় থেকে মাটি ধসে পড়লে তাকে প্রথমে নাইক্ষ্যংছড়ি ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিলে তাকে চিকিৎসার জন্যে ভর্তি করা হয়। এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ বিষয়ে সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমন বলেন, ঘটনা সত্য। তার মৃত্যু হয় পাহাড় ধসে।