রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর: ৩ দিনের টানা ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ২৪ ঘন্টায় শেরপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের পানি কিছুটা নেমে গেলেও নিম্নাঞ্চলের অন্তত দেড় শ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া শ্রীবরদী, শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলা আরও ৫০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে জেলায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাটসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন আবাদ, মাছের ঘের ও সবজি আবাদ। পানিবন্দী হয়ে আছে ৩ উপজেলার প্রায় ১ লাখ মানুষ।
এদিকে পাহাড়ি ঢলে নালিতাবাড়ীতে এক বৃদ্ধ ও নারীর মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ হয়েছেন আরও ৩ জন। এ ছাড়া ঝিনাইগাতীতে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে উজান থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক ব্যক্তির লাশ ভেসে এসেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
নালিতাবাড়ীতে নিহত ২ জন হলেন বাঘবেড় গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী ওমিজা খাতুন (৪৫) ও আন্ধারুপাড়া গ্রামের ইদ্রিস মিয়া (৮০)। এ ছাড়া উপজেলার নন্নী অভয়পুর গ্রামের বছির উদ্দীনের ২ ছেলে আবু হাতেম (৩০) ও আলমগীর (১৭) এবং বাতকুচি গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের স্ত্রী জহুরা খাতুন (৪৫) নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
শুক্রবার বিকেলে উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া গ্রামে ঢলের পানিতে ডুবে থাকা সড়ক পার হওয়ার সময় ডুবে যান ইদ্রিস মিয়া। পরে স্থানীয়রা খোঁজাখুঁজির পর তার লাশ উদ্ধার করে। এদিকে ঢলের পানি থেকে
নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ রয়েছেন উপজেলার বাতকুচি গ্রামের জহুরা খাতুন ও নন্নী অভয়পুর গ্রামের সহোদর ২ ভাই আবু হাতেম ও আলমগীর।
নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নিখোঁজ ৩ জনের সন্ধান পেতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।]
ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি এবং নালিতাবাড়ীর ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর অন্তত ১০ জায়গায় বাঁধ ভেঙে ও নদীর পাড় উপচে প্লাবিত হওয়া গ্রামগুলোর বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও আবাদ তলিয়ে গেছে। জেলার অন্তত ১৮ হাজার হেক্টর জমির আমন আবাদ সম্পূর্ন ও ১৭ হাজার হেক্টর জমির আমন আবাদ আংশিকসহ ১ হাজার হেক্টর সবজির আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি কার্যালয়। এতে অন্তত ৬৫ হাজার ৪০০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও নদীর পাড় উপচে পানি যাওয়ায় রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নন্নী, পোড়াগাঁও, নয়াবিল, বাঘবেড়, কলসপাড়, মরিচপুরান, যোগানিয়া, রাজনগরসহ ১০টি ইউনিয়ন ও পৌর শহরের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে উপজেলার প্রায় ৬০০ পুকুর ও ১০ হাজার হেক্টর আমন আবাদ তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি ও মৎস্য অফিস।
এছাড়া শনিবার শ্রীবরদী উপজেলার পাশাপাশি অপর ২ উপজেলা শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
এদিকে জেলার সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। শুক্রবার বিকেল থেকে বন্যাকবলিত বেশ কিছু এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও
ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতভর পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করেন।
শনিবার জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেল স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রান সামগ্রী বিতরন করেছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, অবিরাম বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তাদের সরিয়ে আনা হচ্ছে। তবে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত উদ্ধার সরঞ্জাম নেই। শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে। আমাদের সংগ্রহে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার রয়েছে। পানিবন্দী পরিবারগুলোকে তা সরবরাহ করা হচ্ছে।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, শেরপুরে পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়েছে। আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে নৌকা নিয়ে আসা হচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য শুকনো খাবার রেডি করা হচ্ছে। রাতের মধ্যেই সেগুলো পৌঁছে দেওয়া হবে।