সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব গোলাম কিবরিয়া মজুমদার অবশেষে গ্রেফতার হয়েছেন। অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালানোর সময় শনিবার তাকে আটক করা হয়। হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রতিহত করতে মাঠে সক্রিয় আওয়ামী ক্যাডার হিসাবে বিজিবির তালিকায় তার নাম রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোলাম কিবরিয়া সাবেক রেলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএস) ছিলেন। টানা প্রায় আট বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় তার বিরুদ্ধে রেলের বড় বড় ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অনিয়ম দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের আশীর্বাদে তার কিছুই হয়নি। পরে রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে তিনি রেলওয়ের বহুল আলোচিত কালোবিড়াল নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
সূত্র জানায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ছেলে কিবরিয়া সংসদ সচিবালয়ের একজন সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এমপি মুজিবুল হককে রেলমন্ত্রী করা হলে তার কপাল খুলে যায়। মুজিবুল হক কিবরিয়াকে একান্ত সচিব (পিএস) নিয়োগ করেন। পিএস পদ কাজে লাগিয়ে কমিশন বাণিজ্য ও নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, রেলমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ পাওয়া মুজিবুল হক বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। এছাড়া নানা রোগে আক্রান্ত রেলমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের রুটিন দায়িত্বসহ দৈনন্দিন কাজও ঠিকমতো করতে পারতেন না। এর সুযোগ নেন তার পিএস কিবরিয়া। এ সময় তিনি মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রকারী হয়ে ওঠেন। এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে গেলে মুজিবুল হক নিজেই তার পিএস কিবরিয়ার সঙ্গে পরামর্শের নির্দেশ দিতেন। ফলে কিবরিয়ার সিদ্ধান্তের বাইরে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তেমন কিছুই করার ছিল না।
জানা যায়, মন্ত্রণালয় ছাড়াও মুজিবুল হকের ব্যক্তিগত নানা বিষয় দেখভাল করতেন কিবরিয়া। এক পর্যায়ে আকস্মিক সত্তরোর্ধ মুজিবুল হকের সঙ্গে কিবরিয়ার কথিত বান্ধবী হনুফা আক্তার রিক্তার বিয়ে হয়। মন্ত্রীর এমন অসম বিয়ে দেশজুড়ে তুমুল আলোচনার ঢেউ তোলে। এসব নিয়ে খোদ রেল ভবনেও নানা মুখরোচক গল্প ছড়ায়। কেউ কেউ বলেন, মন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কিবরিয়া পরিকল্পিতভাবে বান্ধবীর সঙ্গে মন্ত্রীর বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। তবে রহস্যজনক কারণে এসব বিষয়ে তৎকালীস মন্ত্রী মুজিবুল হক ছিলেন পুরোপুরি নির্বিকার।
টাকা পাচার: পিএস থাকাকালে কিবরিয়া দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এ সময় তিনি প্রতিবার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সময় লাগেজে করে নগদে বিপুল পরিমাণ ডলার নিয়ে যেতেন। এছাড়া রেলের ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিতে মোটা অঙ্কের অর্থ নিতেন কিবরিয়া। ঘুসের টাকা তাকে ডলারে দিতে হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে কিবরিয়ার অঢেল সম্পদ রয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়। এসব নিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধানের পর প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দুদকে পাঠানো হয়। কিন্তু এ বিষয়ে দুদক থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে মুজিবুল হক রেলমন্ত্রী থেকে বাদ পড়লে কিবরিয়া কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ সময় দুদক তার বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান ফাইল খোলে। পরে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
সূত্র জানায়, বিদেশে সম্পদ ছাড়াও দেশের বাড়ি কুমিল্লা এবং রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তার একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও বহুতল বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে বাসাবো নন্দীপাড়া এলাকায় রয়েছে ছয়তলা বাড়ি। এছাড়া রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে একাধিক প্লট, গুলশানে অন্তত চারটি ফ্ল্যাট এবং একটি বৃহৎ আবাসন কোম্পানিতে তার বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি মজুমদার এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে তিনি রেলওয়ের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যবসা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তা বলেন, সরকারি কর্মকর্তা হলেও শোবিজ জগতে ওঠাবসা ছিল কিবরিয়ার। বিশেষ করে ঢাকায় সিনেমার একাধিক চিত্রনায়িকার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার নানা গল্প চাউর হয়। এমনকি সংসদ এলাকায় তার সরকারি বাসভবনে গভীর রাতে নায়িকা এবং মডেলদের নিয়মিত আড্ডা হতো। এসব আড্ডায় তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকতেন। ওবায়দুল কাদের ছিলেন কিবরিয়ার প্রতিবেশী। দু’জনের বাসাও ছিল পাশাপাশি।
এমপি হওয়ার খায়েশ : কিবরিয়া একসময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। পরে রেলমন্ত্রীর পিএস হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে মধুর হাঁড়ির খোঁজ পান। এ কারণে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও কিবরিয়া নিজেই এমপি হওয়ার দৌড়ে নাম লেখান। রাজধানীর বাসাবো এলাকা থেকে নির্বাচনের জন্য তিনি প্রকাশ্যে জনসংযোগ করেন। এলাকার মসজিদ মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীও প্রতিষ্ঠানে দু’হাতে টাকা ঢালেন। বাসাবো এলাকার একধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হন। এর মধ্যে স্থানীয় তাজউদ্দিন স্কুল কমিটি সভাপতি নির্বাচিত হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন। এছাড়া স্কুল তহবিলের অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাসাবো ছাড়াও কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম এলাকা থেকেও সংসদ নির্বাচনে তার পরিকল্পনা ছিল। তার ধারণা ছিল বয়োবৃদ্ধ মুজিবুল হকের মৃত্যুর পর তিনিই এলাকার হাল ধরবেন। এ জন্য দলীয় হাইকমান্ডে তিনি বিপুল অঙ্কের টাকা ঢালেন। বিশেষ করে দলের সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে তিনি এমপি হওয়ার জন্য এক ধরনের দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন।
ঘুসবাণিজ্য : নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ছাড়াও রেলের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এবং ডিজি নিয়োগে বিপুল অঙ্কের ঘুসবাণিজ্য করেন কিবরিয়া। তার আস্থাভাজন না হলে রেলে ডিজি পদে নিয়োগ পাওয়া ছিল অসম্ভব। বিশেষ করে সাবেক ডিজি আমজাদ হোসেন, সামসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, তোফাজ্জল ও প্রভাবশালী অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) সাগর চক্রবর্তী ছিলেন কিবরিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট। এছাড়া বর্তমান এডিজি পার্থ সরকার রেলওয়ের পরিকল্পনা দপ্তরের প্রধান বেলাল হোসেন, বিতর্কিত পিডি প্রকৌশলী রমজান আলী, আওমী লীগের ঘনিষ্ঠভাজন হিসাবে প্রভাবশালী কর্মকর্তা সুবক্তগীন, প্রকৌশলী মফিজ উদ্দিন, সাবেক জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন ও সাবেক কোটিপতি এডিজি মিয়া জাহান। বর্তমানে তিনি রেলভবনে বসে রেলওয়ের দুর্নীতিবাজদের বিশেষ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিবরিয়ার ঘনিষ্ঠভাজনদের অনেকে ইতোমধ্যে অবসরে গেলেও মিয়া জাহান এখনো রেলভবনে বহাল রয়েছেন। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত মিয়া জাহান অবসরে গেলেও ফের তাকে রেল ভবনে ফিরিয়ে আনা হয়। এমনকি মিয়া জাহানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে বিতর্কিত প্রকল্প তৈরি করে রেল মন্ত্রণালয়। পরে তাকে পিডি করা হয়।
সূত্র জানায়, কিবরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে রেলের সাবেক জিএম মুকবুল হোসেন, প্রকৌশলী ফিরোজি, পিডি শহীদুল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাদরুল নানা সুবিধা আদায় করেন। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুললেও কিবরিয়ার প্রভাবের কারণে তাদের তেমন কিছুই হয়নি।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কসবা প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় কিবরিয়া মজুমদারকে শনিবার রাতে কসবা থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে বিজিবি। এ ঘটনায় বিজিবির নায়েব সুবেদার সফিউর রহমান বাদী হয়ে পাসপোর্ট আইনে মামলা করেছেন। তাকে রোববার ঢাকার পল্টন থানার একটি হত্যা মামলা ও কসবা থানার পাসপোর্ট মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
বিজিবি সূত্র জানায়, কিবরিয়া মজুমদার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের পুটিয়া এলাকার সীমান্ত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্ত এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিলেন। এ সময় সালদানদী বিওপির টহল দল তাকে আটক করে।