ছায়েদ আহমেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি: দিন দিন বন উজাড়, জনবসতি বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বনদস্যুর আক্রমণ সহ নানান বিপরীত পরিস্থিতিতে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের হরিণ সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার দক্ষিনে বর্তমানে "নিঝুম দ্বীপের দেশ" নামে পরিচিত। যা হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত।
চল্লিশের দশকে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠে প্রায় ২৩০ স্কোয়ার বর্গ কিলোমিটারের বাউল্লারচর/ চর ওছমান নামের এই ভূ-ভাগ। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনবসতি। যেখানে ৭৪ সালের দিকে দেশের বনবিভাগ বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে এবং কালক্রমে যা হয়ে উঠে নিঝুম দ্বীপ। হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপ ও জাহাজমারা ইউনিয়নের সরকারি গেজেটভুক্ত ১১ টি চরের সমন্বয়ে ৪০ হাজার ৩৯০ একর এলাকা নিয়ে "নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান" গঠিত হয়। যা ২০০১ সালে সরকার কর্তৃক ঘোষিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বন নিয়ে ১১ নং নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের ঘোষণা দেয়। যা ছিলো জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড মাত্র। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এ ঘোষণা বন্যপ্রাণী(সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ 'র সাথে সাংঘর্ষিক। ফলতঃ ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২ খৃঃ হাইকোর্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় জনস্বার্থে একটি রিট আবেদনও করা হয়।
দ্বীপটিতে হরিণের সংখ্যা নিয়ে জাহাজমারা রেঞ্জ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৭-৭৮ খৃঃ এর দিকে বনবিভাগ নিঝুম দ্বীপ অংশের বনে কয়েক জোড়া চিত্রা হরিণ ছাড়ে। পরবর্তীতে যা কয়েক হাজারে পৌঁছায়। কিন্তু জাতীয় উদ্যান এলাকায় দিন দিন মানুষের বসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। এছাড়া নিঝুম দ্বীপে কুকুর-শিয়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক সময় কুকুর-শিয়ালের আক্রমণে হরিণ আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। উপযুক্ত খাদ্য বা পরিবেশ না থাকায় বিভিন্ন সময়ে জাতীয় উদ্যানের অন্যান্য চরে ছড়িয়ে যেতে পারে বলেও ধারণা করেন উক্ত বনবিভাগ।
জানা যায়, ১৯৯৬ খ্রি. হরিণ শুমারী অনুযায়ী এখানে হরিণের সংখ্যা ছিল প্রায় ২২ হাজারের মতো। যা এখন স্বপ্নের মতো শুনায়। নিঝুম দ্বীপের অভ্যন্তরে খালসমূহ দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকা-ট্রলার চলাচল, সীবিচ এরিয়ায় লাইটহাউজ স্থাপন, ভূমি লোভী, জেলে এবং নতুন নতুন বসতিদের দ্বারা বন উজাড় সহ নানান বিপরীত পরিস্থিতির কারণে মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসার এ মায়াবী হরিণ কমে গেছে বলে মত প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।
এদিকে, হরিণের জন্য সুপেয় পানি ও নিরাপত্তার জন্য নির্মিত পুকুরসমূহের উঁচু পাড় ইতোপূর্বে বিভিন্ন বন্যায় ভেঙে গেছে। এতে হরিণের সুপেয় পানি ও নিরাপত্তার সংকট দেখা দিয়েছে। তাই পুকুরসমূহের সংস্কারের জোর দাবি করেন এলাকাবাসী।
নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা সংক্রান্তে সেখানকার দুলাল উদ্দিন নামের এক সমাজকর্মীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, হরিণ এখন সোনার হরিণ হয়ে গেছে! গেল ৩-৪ বছর আগেও এখানকার বিভিন্ন বাগানে ঢুকলেই হরিণ দেখা যেতো। এখন দিনকে দিন অপেক্ষা করলেও হরিণের দেখা মিলে না। এর কারণ হিসেবে নিঝুম দ্বীপে জনবসতি বৃদ্ধিসহ নানান বৈরী পরিস্থিতি কে দায়ী করেন তিনি।
চানমিয়া নামের স্থানীয় এক মেম্বার জানান, নিঝুম দ্বীপ এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিমের চরে প্রচুর মহিষ বিচরণ করে, ফলে হরিণ একদিকে ঘাস পায়না অন্যদিকে গাছের পাতাও তেমন পায় না। এসব কারণেও হরিণ কমে যেতে পারে বলে তিনি জানান।
জাহাজমারা বন কর্মকর্তা সাইফুর রহমান জানান, নিঝুম দ্বীপ বনাঞ্চলে হরিণের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য শোনা গেলেও সরকারিভাবে সঠিক কোন পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তবে স্থানীয়ভাবে তথ্য প্রকাশের নজির আছে। তিনি জানান, অতীতে হরিণ নিধন ও পাচারের ঘটনা ঘটলেও বর্তমানে তা নেই। জাতীয় উদ্যান এলাকার বিভিন্ন চরে নতুন নতুন ম্যানগ্রোভ বনায়ন সৃজনের মাধ্যমে হরিণের খাদ্য ও উপযুক্ত বাসস্থানের পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এবং মার্চ,২০২৪ থেকে 'জাতীয় উদ্যান' এলাকায় "স্মার্ট পেট্রোলিং" কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।