জাবেদ হোসাইন মামুন, সোনাগাজী (ফেনী) প্রতিনিধি: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গলায় বুলেটবিদ্ধ ফেনীর মাদরাসা ছাত্র শাহীনের চিকিৎসা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পাননি কোন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য। নিজের টিউশনি করা টাকায় চালাচ্ছেন চিকিৎসা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে ফেনীর মহিপালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ফেনী আলীয়া মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষের ছাত্র আবুল হাসান ওরফে শাহীন (২১)। সে চরচান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চরচান্দিয়া গ্রামের ফল ব্যবসায়ী এনায়েত উল্যাহর ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সে তৃতীয়। জেলা সদর হাসপাতাল থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও গলা থেকে সেই গুলি বের করা যায়নি। গলায় আটকে থাকা গুলি নিয়ে আবুল হাসান গত এক সপ্তাহ ধরে ফাজিল প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। খাবার খাওয়ার সময় তেমন একটা সমস্যা না হলেও বিছানায় শুলে কাঁধে ও গলার নিচের দিকে যন্ত্রণা শুরু হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় অর্থের অভাবে তাঁর উন্নত চিকিৎসাসহ গলা থেকে গুলি বের করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে আবুল হাসান। পরিবার থেকে তেমন একটা সহায়তা না পেলেও আবুল হাসান নিজেই টিউশনি করে ঔষুধ খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
আহত শাহীন ও আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানায়, গত ৪ আগস্ট রোববার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপাল এলাকায় মিছিলে ছিলেন মাদ্রাসা ছাত্র আবুল হাসান শাহীন। মিছিল করে আবুল হাসান বন্ধুদের সঙ্গে মহিপাল উড়াল সেতুর পশ্চিম পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে জোহরের নামাজের সময় হওয়ায় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে সড়কে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ হতে না হতেই ফেনী শহরের ট্রাংক রোড থেকে আওয়ামী, যুব ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অস্ত্রসহ এসে ছাত্রদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে আবুল হাসানসহ অন্তত ৫০ জনের বেশি ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত নিহত হন অন্তত ১৩জন।
আবুল হাসানের বাবা এনায়েত উল্যাহ বলেন, তার ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মিছিলে যোগ দেয়। ওই দিন দুপুরের দিকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে গলায় গুলিবিদ্ধ হয় আবুল হাসান। পরে সহপাঠিরা তাকে উদ্ধার করে ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গুলি বের করার যন্ত্রপাতি না থাকায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। খবর পেয়ে তিনি দ্রুত ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যান। সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে দুদিন থাকার পর চিকিৎসকরা গলা থেকে গুলি বের করতে না পেরে তাকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আবুল হাসানের গলার গুলিটি এই মুহূর্তে বের করতে গেলে অন্যান্য রগ কেটে তার বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেসরকারি কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। এতে অনেক টাকা খরচ হতে পারে। পরে ঢাকা থেকে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। অর্থের অভাবে ছেলের গলা থেকে গুলি বের করতে না পেরে হতাশা প্রকাশ করেন বাবা।
এনায়েত উল্যাহ আরও বলেন, ‘আমার পাঁচ ছেলে। আমি একজন অসহায় বাবা। সামান্য ফলের দোকান করে ছোট দুই ছেলেসহ পাঁচজনের খাবার জোগাড় করা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। আমার ছেলে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে গলায় গুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক কষ্টে দিন পার করছে। টাকার অভাবে ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছিনা। ছেলে টিউশনি করে নিজের ওষুধ খরচ সামাল দিচ্ছে। এটা আমার জন্য অনেক লজ্জা ও হাতাশার। ছেলেকে নিয়ে কী করবো বুঝতে পারছি না। উন্নত চিকিৎসার দিয়ে তার গলার গুলি বের করা দরকার। কিন্তু আমরা এত টাকা কোথায় পাব? নিজেদেরই চলতে কষ্ট হয়। এ অবস্থায় তিনি বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন।
শাহীন বলেন, গলায় গুলি থাকায় সব সময় কাঁধে এবং শুলে গলার নিচের দিকে যন্ত্রণা শুরু হয়। মাঝে মধ্যে বেশি ব্যথা হলে খুব খারাপ লাগে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ভালো চিকিৎসা করতে পাচ্ছেন না। গলায় গুলি বের করতে অনেক হাসপাতালে গিয়েছি। কোন হাসপাতালে গুলি বের করার যন্ত্রপাতি নেই, আবার কোথাও চিকিৎসক নেই। একেকজন একেকজনকে দেখিয়ে দেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তার গলায় যে গুলিটি আটকে আছে, তা বন্দুক বা শর্টগানের গুলি হতে পারে। এ মুহূর্তে অস্ত্রোপচার করে গুলিটি বের করলে তার বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। গলার অন্যান্য রগ কেটে ও খাদ্যনালিতে সমস্যা হতে পারে। তাই সরকারি হাসপাতালগুলোতে কেউ অপারেশন করতে চাইছেন না। বরং বেসরকারি উন্নত হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। বেসরকারিতে অনেক টাকার প্রয়োজন। তাই বাসায় থেকে টিউশনির টাকা দিয়ে ব্যথার ওষুধ খেয়ে দিন পার করছি। আবুল হাসান বর্তমানে ফেনী শহরে এক বন্ধুর সঙ্গে থেকে টিউশনি করে নিজের খাবার ও ওষুধ খরচ মিটাচ্ছেন।
শাহীন আরও বলেন, গলায় গুলি নিয়ে বেঁচে আছি। অর্থের অভাবে গলার গুলি বের করতে না পেরে হতাশায় ভুগতেছি। ভবিষ্যতে কি করবো বুঝে আসছে না? পায়নি কোন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য। ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে ইসলামি আন্দোলন থেকে সামান্য আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।
সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ছাত্র আন্দোলনে আহত ও নিহতদের খোঁজ খবর নিয়ে তালিকা করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের পাশাপাশি আহতদেরকেও পর্যায়ক্রমে চিকিৎসাসহ সহায়তা করা হবে।