জলিল রহমান, পটুয়াখালী প্রতিনিধি: পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাংলী দেখিয়ে ইলিশের প্রজনন মৌসূমে পায়রা বন্দর সংলগ্ন রাবনাবাদ ও পাটুয়া নদীসহ জেলার বিভিন্ন চরে অবাধে বালু কাটা হচ্ছে । এতে ইলিশের অবাধ প্রজনন বিঘ্নের পাশাপাশি হুমকিতে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। ভেস্তে যেতে বসেছে মা ইলিশ রক্ষার সকল আয়োজনও । যার বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী ইলিশ মৌসূমে। ইলিশের স্বাভাবিক প্রপ্যতা নিশ্চতে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী বিশেষজ্ঞদের।
১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এসময় ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে নদীর মিঠা পানিতে ছুটে আসে মা ইলিশের ঝাঁক। নদীর পানিতে নিশিক্ত হয়ে ইলিশের ডিম রুপ নেয় জাটকায়। এই প্রক্রিয়ায়ই ইলিশের বংশবিস্তার হয়। এই সময়ে ইলিশ প্রজনন নির্বিঘ্নে করতে সাগর মোহনা ও নদীতে ড্রেজিং ও বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনকে ব্যাবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি। প্রশাসনও জেলা উন্নয়ণ ও সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় জেলার সকল নদীতে বালু উত্তোলণ এবং ড্রেজিং না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেন্জ করে সাগর মোহনা ও নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা। তড়িত বালু উত্তোলণের জন্য পটুয়াখালীর নদী ও সাগর মোহনার মাঝখানে স্থায়ীভাবে নোঙ্গর করা রয়েছে বালু কাটার ড্রেজার।
এসব চর থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলণ করে বাল্বহেড জাহাজে পরিবহণ করে জেলার বিভিন্ন এলাকয় ফেলা হলেও অজ্ঞাত কারনে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এনিয়ে আছে ভিন্ন আলোচনাও। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের ভাগে ভাগে টাকা দিয়েই বালু উত্তোলণ করা হচ্ছে বলে জানাগেছে। কেউ কেউ নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে জানান, এই বালু উত্তোলনের সাথে সব সময়ই প্রভাবশালীরা জড়িত থাকেন। তাদের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই ইলিশের এই প্রজনন মৌসূমের নিষিদ্ধকালীন সময়ের নদী কেটে বালু উত্তোলণ করা হচ্ছে।
এই খাতে প্রতিদিন লাখলাখ টাকার লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। অপরিকল্পিত এই বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জেলে ও নদীতীরে বসবাসরত মানুষেরা। পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ার শংকাও তৈরী হয়েছে। এতে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন নদী তীরের মানুষরা। কলাপাড়ার রামনাবাদ নদীতীরের চালিতাবুনিয়া মৌজার বাসিন্দা মোঃ ইয়াকুব আলীসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা বলেন, রাত দিন নির্বিচারে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে তাদের ঘরবাড়ি নদীতে ভেংগে যাচ্ছ। তারা বাঁধা দিতে গেলে রাজনৈতিক নেতাদের হুমকি ধামকির শিকার ও হামলা মামলা দিয়েও হয়রানী করা হয় তাদের ।
নদীতে নোঙ্গর করা লোড ড্রেজার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী রবিউল ও রাহাত হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, গত ৩ মাস ধরে তারা এই নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছেন। তাদের কোম্পানীর নির্দশনা অনুযায়ী তারা বালু উত্তোলন করেন। প্রতিদিন ৫/৬ টি বাল্কহেড পূর্ণ করে দেন তারা। প্রতি মাসে ৬/৭ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করার কথা জানান বালু ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা।
লোড ড্রেজার রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের চালক মোঃ আঃ রহিম বলেন, একমাস আগে তিনি এখানে এসেছেন। প্রতিদিন ৪/৫ বাল্কহেড বালু তোলেন তারা। কোন কাগজ পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন সেটা কোম্পানী জানে, তাদের এখানে বালু কাটতে বলেছে, তাই তারা কাটছেন, এর বেশি কিছু তারা বলতে পারেন না। চলতি বছর কলাপাড়া ও রাংগাবালী উপজেলার কোন বালু মহলের সরকারী ইজারা না থাকলেও প্রতিদিন লাখালাখ ঘনফুট বালু উত্তোলণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রভাবশালী চক্র।
অপরিকল্পিত ভাবে বালু কাটার কারনে ইলিশের প্রজনন বিঘ্নের আশংকায় কথা উল্লেখ করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের এ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ লোকমান আলী বলেন, ইলিশের প্রজননকালীন সময়ে ড্রেজার বন্ধ রাখা খুবই জরুরী। তার প্রধানতম কারন হলো ইলিশ মাছ নদীতে যখন ডিম ছাড়ে, ডিমো পানিতে মিশে যায় এসময় ড্রেজার চালানো হলে পানি ও বালুর সাথে অনেক ডিম উঠে আসবে এবং অনেক ডিম ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এছাড়া মা ইলিশ যখন ডিম ছাড়বে ড্রেজারের শব্দে তাদের নদীতে মুভমেন্ট করার সময় বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃস্টি হতে পারে । দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন ড.মোঃ নুরুল আমিন বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন করা হলে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি পাবে ফলে নদী তীরে ভাঙ্গন সৃস্টি হওয়ার পাশাপাশি গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাড়বে। এছাড়া নদীগর্ভে যেসকল হেভি মেটাল রযেছে তা পানিতে মিশবে এবং অক্সিজেনের ঘাটতি হবে এতে বায়োডাইভারসিটি বিনষ্ট হবে। মাছের উৎপাদন কমে যাবে এবং পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন, ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করতে এ সময় নদ নদীতে সকল ধরনের ড্রেজিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স কমিটি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট বালু মহাল ছাড়া নদ-নদীতে ড্রেজিং করা হলে তীর ভাঙ্গার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও এসব অবৈধ ড্রেজিং ঠেকাতে প্রশাসন কাজ করছে।
এ বিষয়ে লোড ড্রেজার মেসার্স তায়্যিবা এন্টারপ্রাইজের মালিক এসএম শিপন মুঠোফোনে ইলিশের চলমান প্রজনন মৌসুমে অবৈধভাবে বালু কাটার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি ব্যস্ত আছেন পরে কথা বলবেন বলে মাবাইল রেখে দেন।
এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম চলাকালে নদ নদীতে ড্রেজিং করা নিষিদ্ধের ব্যাপারে আমার জানাছিল না খোজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
জেলা প্রশাসক আবুল হাসানাত মোহাম্মদ আরেফিন যুগান্ডরকে বলেন, বৈধ অবৈধ বালু মহল গুলোতে ইলিশের চলমান প্রজনন কালীন সময়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলণ করা হচ্ছে আপনার কাছে এই শুনলাম, আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিচ্ছি।