গাজীপুরে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে টানা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছেন পোশাক শ্রমিকরা। পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কোনো আশ্বাস ও কথাই শুনতে নারাজ শ্রমিকরা। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সড়কেই অবস্থানের পক্ষে অনড় রয়েছেন তারা। এতে মহাসড়কে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। রোববার (১০ নভেম্বর) সকালেও অবরোধ অব্যাহত রয়েছে।
শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে শুরু হওয়া সড়ক অবরোধের কারণে এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী মানুষ ও পরিবহন চালকরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। শনিবার দুপুর থেকে অবরোধ সরিয়ে নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বারবার আশ্বস্ত করলেও সারারাত তাদের অবরোধ অব্যাহত রাখেন। শ্রমিকরা মহাসড়কেই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে গাজীপুর মহানগরের মালেকের বাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস্ লিমিটেড নামের কারখানার শ্রমিকরা। এতে মহাসড়কের উভয় পাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দেশের ব্যস্ততম এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ পড়েন চরম ভোগান্তি আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগে।
এর আগে ওই কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপরই শ্রমিকরা মালেকের বাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয় পাশে তীব্র যানজটের তৈরি হয়। অনেক যানবাহন ১৫-২০ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় যানজটে আটকা পড়ে আছে।
রাজশাহী থেকে ট্রাকযোগে পণ্য নিয়ে আসা চালক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘শনিবার সকাল ১০টার দিকে ভোগড়া বাইপাস মোড়ে আসি। রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত মাত্র আধা কিলোমিটারের মতো পথ আসতে পেরেছি। রাস্তা সরু হওয়ায় গাড়ি ঘুরিয়ে বিকল্প পথে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।’
প্রাইভেটকারের চালক সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘জরুরি কাজে অফিসের স্যারকে নিয়ে শনিবার দুপুর থেকে বাসন সড়ক এলাকায় আটকা পড়েছি। বিকল্প যানে বস চলে গেলেও আমি রাস্তায় পড়ে আছি। খাবার, গোসল সবকিছু বন্ধ। গাড়ি রাস্তায় রেখে কোথাও যেতেও পারছি না। সারারাত গাড়ির মধ্যে আতঙ্কে নির্ঘুম কাটিয়েছি।’
নওগাঁ থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আসা যাত্রী শরিফ আহমেদ বলেন, ‘সকালে ভোগড়া বাইপাস মোড়ে বাস থেকে নেমে ঢাকায় যাওয়ার কোনো যানবাহন না পেয়ে দুই সন্তান, স্ত্রী ও দুটি ব্যাগ নিয়ে অনেক কষ্ট করে এক কিলোমিটারের মতো পথ হেঁটে এসেছি। এখন আর পারছি না। জানতে পারলাম আরও এক কিলোমিটার পথ হেঁটে পার হলে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে।’
রোববার ভোরে অবরোধস্থল কলম্বিয়া এলাকায় গেলে দেখা যায় শ্রমিকরা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে সড়কের উভয় পাশে অবস্থান নিয়েছেন। দুই পাশের কয়েকটি বাস ও ট্রাক আড়াআড়িভাবে রেখে সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছেন। অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলও চলাচল করতে দিচ্ছেন না আন্দোলনরত শ্রমিকরা।
সড়কে নির্ঘুম রাত কাটানো শ্রমিক রেহেনা আক্তার বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। পুলিশ ও প্রশাসন বারবার আমাদের বকেয়া বেতন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে আমাদের দাবি মেটানো হয়নি। বাসা ভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করতে পারছি না। ঘরে খাবার নেই, সন্তানকে বাবার কাছে রেখে আমি বেতনের দাবিতে সারারাত রাস্তায় কাটিয়েছি।’
অপর শ্রমিক সালমা আক্তার বলেন, ‘আমরা মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্টের কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের কষ্টের কথাও সবাইকে বুঝতে হবে। আমরা শখ করে রাস্তায় রাত জেগে বসে থাকিনি। আমরা আমাদের বকেয়া বেতন পেলেই অবরোধ তুলে নেবো।’
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধের কারণে সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের দক্ষিণ দিকে টঙ্গীর কাছাকাছি যানজট গিয়ে পৌঁছেছে। অনেক গাড়ি বিকল্প পথে চলাচল করছে। আমরা মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ, উত্তর) নাজির আহমেদ বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ বার শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত তাদের বকেয়া আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে বলেও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতীতে মালিকপক্ষ কথা রাখেনি এমন অভিযোগ তুলে শ্রমিকরা প্রথমে বলেছিল দুপুর ২টায় অবরোধ তুলে নিবে। পরে বলেছিল বিকেল পাঁচটায় অবরোধ তুলে নিবে, কিন্তু তারা অবরোধ তুলে নেয়নি। তারপরও আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা কোনো আশ্বাস মানতে রাজি হচ্ছে না। ফলে মহাসড়কের যানজট নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না।’