ঢাকা
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
দুপুর ১:৫৬
logo
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২৪

‘কলকাকলি স্টেশনে’ দাঁড়িয়ে আছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’

মো: মেহেদী হাসান, পুঠিয়া (রাজশাহী) প্রতিনিধি: ‘কলকাকলি স্টেশনে’ চারটি বগি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’। গন্তব্য ‘ধাদাশ টু মহাকাশ’। ছোট ছোট শিক্ষার্থী ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে। নেই ট্রেন লাইন, নেই ট্রেনের ইঞ্জিন। আছে শুধু কয়েকটি বগি (কোচ)। সঙ্গে যাত্রী বেশে শিশু শিক্ষার্থীরা। ট্রেনের একেকটি বগি একেকটি ক্লাস রুম। শুনতে অবাক লাগার মত হলেও, বাস্তবে তাই। এমন ক্লাস রুমগুলোতে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কোমলমতিদের পাঠদান করেন শিক্ষকরা। তবে ট্রেনের বগির আদলে ক্লাস রুমের রঙ করা নিয়ে বেশ সাড়া পড়েছে উপজেলা-জেলা জুড়ে। ১৯৬৭ সালে নির্মিত পুরোনো এই ভবন রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার ধাঁদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ে ৩০৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তারমধ্যে ছাত্র ১৩৮ ও ছাত্রী ১৭১ জন। ছাত্রের তুলনায় ৩৩ ছাত্রী শিক্ষার্থী বেশি। প্রাক-প্রাথমিকে ১৫ জন ছাত্র ও ২৯ জন ছাত্রী পড়াশোনা করে। প্রথম শ্রেণিতে ২৩ জন ছাত্র ও ২৫ জন ছাত্রী, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩৪ জন ছাত্র ও ২৩ জন ছাত্রী, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৭ জন ছত্র ও ৩৮ জন ছাত্রী, চতুর্থ শ্রেণিতে ২৪ জন ছত্র ও ২৭ জন ছাত্রী এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১৫ জন ছাত্র ও ২৮ জন ছাত্রী পড়াশোনা করে। তাদের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণিতে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্রী পড়াশোনা করে।

শিক্ষার্থী রাফিয়া জানায়, তাদের এই ট্রেন গাড়িতে ক্লাস করতে ভালো লাগে। আমাদের স্কুলের মতো ট্রেন গাড়ি কোনো স্কুলে নেই। আমাদের আপারা ট্রেন গাড়ি সমন্ধে বলেছেন। ট্রেন গাড়ির একটা নাম থাকে। স্টেশন থাকে। কোথায় থেকে যাবে। কোথায় থামবে।

স্কুলের শিক্ষার্থী নাসরিন খাতুন বলেন, আমাদের আগে ক্লাস রুম ভালো লাগতো না। এখন বেশ ভালো লাগে। এটির জন্য সবাই আগে ক্লাসে চলে আসি। আরেক শিক্ষার্থী নাজরিন বলেন, এখন আমাদের খুব ভালো লাগে। মনে হয় ট্রেনে চড়ে ক্লাস করছি।

স্কুলটির শিক্ষিকা ফারজানা খাতুন বলেন, আসলে ভবনটি অনেক পুরাতন। এটি দেখতেও খারাপ লাগতো। প্রধান শিক্ষিকা এটি নিয়ে একটি আইডিয়া চান। পরে এটিকে নিয়ে বানান। এটি বানানোর পর অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি ট্রেন। আসলে এটি একটি রূপক ট্রেন। এটি হবার পর শিক্ষার্থীরা অনেক আগ্রহী হয়েছে। তারাও ক্লাসে আসছে। আমাদেরও বেশ ভালো লাগছে।

প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন জানান, ২০১০ সালে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন। তিনি দেখেন, ওপরে টিন। পরিত্যক্ত ঘোষণা হলেও শ্রেণিকক্ষ সংকটে এখানেই তিনটি কক্ষে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। এ নিয়ে বাচ্চাদের মন খারাপ হতো। তিনটি ভবনের প্রতিটিই জরাজীর্ণ। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালগুলো মলিন। ভেতরে শুধু ব্ল্যাকবোর্ড, আর চক-ডাস্টার। স্কুলের আঙিনায় বালু। গাছ নেই, ফুল নেই, সুন্দর পরিবেশ নেই। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কম। গ্রামের মানুষ স্কুলের ভবনে মই ভিড়িয়ে ছাদে ওঠে। ধান শুকাতে দেয়। স্কুলের আঙিনায় শুকাতে দেওয়া হয় পাট।

ছাত্র-ছাত্রীরা প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলে, সামনের দুটি ভবনে ছাদ আছে, তাদের নেই। তাদের শ্রেণিকক্ষগুলোও যেন সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়। স্কুলে টিফিনের সময়ই অনেক শিক্ষার্থী চলে যেত। প্রধান শিক্ষক তা বন্ধ করেন শিশুদের বুঝিয়ে। প্রতিবছরই পঞ্চম শ্রেণিতে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেতে শুরু করে। শূন্যে নামে ঝরে পড়ার হার। তাই ২০২২ সালে স্কুলটি জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পদক পায়। চলতি বছরেও বিভাগীয় পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছে। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। মাইক্রোসফট এডুকেশন প্রোগ্রামের মাইক্রোসফট শোকেস স্কুলের তালিকাতেও রয়েছে এই স্কুল।

এরপরে ২০০০ সালে কয়েকটি ক্লাসরুম নির্মাণ করা হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। তবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরানো ভবন অন্তনগর ট্রেনের বগির আদলে রঙ করা হয়েছে। যা দূর থেকে দেখে মনে হবে ট্রেনের কয়েকটি বগি থেমে আছে ধাঁদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পুরোনো টিনশেড ভবনকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে আন্তনগর ট্রেনের আদলে একটি বিদ্যালয়কে। অচেনা যে কেউ দেখলেই বলবে, স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে আস্ত একটা আন্তনগর ট্রেন।

স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাসটি যেন একটি শিশুপার্ক। স্কুলের পুরো আঙ্গিনা জুড়ে ফুলের বাগানে ও পশু-পাখির ভাস্কর্য। খেলার জন্য দোলনা নানা উপকরণ। অফিস কক্ষের সামনে সুন্দর মঞ্চ। ছোট্ট মাঠের পুরোটিতেই দৃষ্টিনন্দন টালি বসানো। সব কটি শ্রেণিকক্ষই সাজানো-গোছানো। দেয়ালগুলো রঙিন ফুলে-ফলে। কাগজের ফুল দিয়ে শ্রেণিকক্ষ সাজিয়ে রেখেছে শিক্ষার্থীরাই। বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকের পুরোনো টিনশেড ভবনটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে রেলগাড়ির আদলে। ভবনের ওপরে ‘কলকাকলি স্টেশন’ লেখা সাইনবোর্ড। রেলগাড়িটির নাম লেখা হয়েছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে অংশে ট্রেনের বগির রঙ করা হয়েছে তার আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে। এখানে ট্রেনের নাম ও স্টেশনের আলাদা আলাদা নাম রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়-কোথা থেকে কোথায় যাত্রা করবে তাও নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা খাতুন আরো বলেন, আমরা চাচ্ছিলাম শিক্ষার্থী অন্যরকম কিছু উপহার দিতে। আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল ক্লাসরুমটা এমন করা যাতে শিক্ষার্থীদের ভালো লাগে। সেই চিন্তা ধারা থেকে ট্রেনের বগির আদলে রঙ করা হয়েছে। এই ট্রেনের বগিগুলো শুধু বগি না। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ম্যাসেজ দেওয়া হয়েছে। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট কোড, সারদা পুলিশ এ্যাকাডেমির কোর্ড, পুঠিয়ার কোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পড়াশোনা ও স্কুলে আসার প্রতি মনোযোগী হয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের লেখাপাড়া ও পাসের হার ভালো। আমার কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা। আমরা সেটা পেরেছি। শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসে সবধরনের বিনোদন পায় পড়াশোনা করে। এখানে ৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। তারমধ্যে একজন পুরুষ ছাড়া বাকিরা নারী শিক্ষক। শিশুরা আনন্দের সঙ্গেই এই স্কুলে আসে। প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা শুরু করার জন্য প্রতিবছরের ফ্রেরুয়ারিতে এ স্কুলে ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠান হয়। সেদিন স্কুলের আঙিনায় বসিয়ে শিশুদের প্রথম হাতের লেখা শেখানো হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে রং, পেনসিল, খাতা, কলম, বিস্কুট ও চকলেট উপহার আসে।

স্কুলটিতে ‘ভালো কাজের শিকল’ নামের একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বছরের শুরুতে স্কুলটির সব শিক্ষার্থীকে একটি করে নোটবুক দেওয়া হয়। প্রতিদিন কোন শিক্ষার্থী কী ভালো কাজ করেছে, তা এখানে লেখা হয়। তারপর প্রতি মাসে পড়ে শোনানো হয় শ্রেণিকক্ষে। যে শিক্ষার্থীর কাজগুলো সবচেয়ে বেশি ভালো মনে হয়, তাদের দেওয়া হয় ‘খুদে আলোকবর্তিকা’ লেখা ব্যাজ। এসব কার্যক্রমের কারণে আনন্দেই স্কুলে আসে শিক্ষার্থীরা।

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram